দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সংঘটিত হলোকাস্টে ৬০ লাখ ইহুদির প্রাণহানি হয়। পরবর্তীতে এটিকে ইহুদিদের নিজেদের আবাসভূমির দাবির বিরাট এক যৌক্তিকতা রূপে দেখানো হয়। তবে তার আগেই ১৯৩৭ সালে পিল কমিশনের বিভাজন পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ৩০ শতাংশ ইহুদিদের প্রদানের কথা বলা হয়। পরের বছর আরও দু’টো বিকল্প বিভাজন পরিকল্পনা দেওয়া হয়।
এরপর ১৯৪৭ সালে ব্রিটেনের অনুরোধে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিন বিভাজন পরিকল্পনা গ্রহণ করে। যেখানে ভূখণ্ডটিকে ‘আরব রাষ্ট্র, ইহুদি রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে জেরুজালেম’— এই তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়। আরবরা এর বিরোধিতা করে। কিন্তু ততদিনে ইউরোপ থেকে ইহুদি অভিবাসীর স্রোত তখন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বিরাট আকার ধারণ করছে। ব্রিটিশ সরকার নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করলেও তা সেভাবে কাজে দেয়নি। বরং ইহুদি রাষ্ট্রের দাবিতে ইহুদি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো তৎপর হয়ে ওঠে। জায়নবাদী নেতারা তাদের মদদ দিতে থাকেন।
আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের দুই মাস আগে ১৯৪৮ সালের ১০ মার্চ ডেভিড বেন গুরিয়ান ও অন্যান্য শীর্ষ জায়নবাদী নেতা গোপনে মিলিত হন, ফিলিস্তিনিদের নৃতাত্ত্বিক শুদ্ধি অভিযান চরমে তোলার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে। এর সাংকেতিক নাম দেওয় হয় প্ল্যান দালেত (প্ল্যান ডি)। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ১৯৩০-এর দশকে, যখন ন্যাশনাল মিলিটারি অর্গানাইজেশন ও স্টার্ন গ্যাঙের মতো ইহুদি সন্ত্রাসী বাহিনীগুলো গঠন করা হয়। প্ল্যান ডির অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনি গ্রাম ও শহরগুলোয় বোমা হামলা ও লুটতরাজ চালিয়ে মানবশূন্য করে ফেলা হয়, যেন ন্যূনতম আরব জনগোষ্ঠী নিয়ে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়।
মিশর ও জর্ডানের গাদ্দারি
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের যে প্রস্তাব অনুসারে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, সেই একই প্রস্তাব অনুসারে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রেরও প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কথা। এদিকে, প্রায় সাত দশক পরে ইসরায়েল এখন বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ। আর ফিলিস্তিনবাসীর জন্য স্বাধীনতা অধরাই রয়ে গেছে।
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করে দুটি রাষ্ট্র (একটি ইহুদি, অন্যটি আরব) গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। অসম ও অন্যায্য এই যুক্তিতে আরবেরা সে সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। উল্টো ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষিত হলে প্রতিবেশী চারটি আরব দেশ মিসর, সিরিয়া, জর্ডান ও ইরাক একযোগে ইসরায়েলকে আক্রমণ করে। সেই যুদ্ধে আরবেরা পরাজিত হয় এবং ইসরায়েল জাতিসংঘ পরিকল্পনায় তাদের জন্য বরাদ্দকৃত ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের অর্ধেক দখল করে নেয়।
এরপর যে এক চিলতে জমি পড়ে রইল, সেখানে স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠা করা যেত। কিন্তু সেই পথে না গিয়ে মিসর ও জর্ডান তা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম গেল জর্ডানের বাদশাহর কবলে, গাজার দখল নিল মিসর। এরপর গত ৭০ বছরে আরব সাগর দিয়ে অনেক পানি বয়ে গেছে, তার চেয়েও বেশি গেছে ফিলিস্তিনিদের জীবন।
ফাতাহ ও হামাসের দ্বন্দ্ব
১৯৯৩ সালে সম্পাদিত অসলো প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থার মধ্যে যে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়, তার ভিত্তিতে ১৯৯৬ সালে পশ্চিম তীর ও গাজায় শুধু নামেই ফিলিস্তিনি স্বায়ত্তশাসন কায়েম হয়। তত দিনে অবশ্য সেই অঞ্চলের একটা বড় অংশ ইসরায়েলের অবৈধ বসতির কবলে, অথবা সরাসরি সামরিক নিয়ন্ত্রণে। নামেই স্বায়ত্তশাসন, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে ইসরায়েলি প্রহরা, উঁচু দেয়াল, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে হলে ইসরায়েলি অনুমতি, ফলে এমন দেশকে স্বাধীন বলা কোনভাবেই সঙ্গত নয়।
কিন্তু সেই প্রশাসনও দুই টুকরা হয়ে গেল ২০০৬ সালের নির্বাচনের পর। পশ্চিম তীর গেল ফাতাহর নিয়ন্ত্রণে, গাজা গেল ইসলামিক ব্রাদারহুডের মিত্র হিসেবে পরিচিত হামাসের। হামাস সন্ত্রাসবাদী দল ও ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে না, এই অভিযোগে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও য়ুরোপিয়ান ইউনিয়ন দলটির সঙ্গে সব সম্পর্ক বর্জন করে। যতদিন না হামাস-ফাতাহ সমস্যা মিটছে, ততদিন ফিলিস্তিন প্রশ্নে শান্তি চুক্তি অসম্ভব।
‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমা থাকায় হামাসের ওপর আক্রমণ করেও ইসরায়েল পার পেয়ে যায়, এমনকি নিজেকে নৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠ দাবি করতে পারে। ফলে এই কাজিয়া চলতে থাকাই ইসরায়েলের জন্য লাভজনক। অন্যদিকে নিজেরা যে আলাপ-আলোচনা করে সমস্যা মেটাবে, ফাতাহ বা হামাস— কেউই তাতে আগ্রহী নয়। কারণ, ঝগড়া মেটামাত্রই নির্বাচন হবে, আর সেই নির্বাচনে দুই দলের চলতি নেতৃত্বের প্রত্যেকে যে বিদায় নেবে, তাতে সন্দেহ নেই।
অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ মদদে যখন ইসরায়েল রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়, তখন এই ভূখণ্ডের দুই-তৃতীয়াংশ ছিল ফিলিস্তিনি। আর এক-তৃতীয়াংশ ছিল ইহুদি। ব্রিটিশ ম্যান্ডেট বা ব্রিটিশ-শাসিত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডটির ওপর ১৯৪৮ সালের ১ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট শেষ হয়। ব্রিটিশরা এই ভূখণ্ডটি ছেড়ে যাওয়ার প্রাক্কালে এর ৫৮ শতাংশ নবঘোষিত ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য বরাদ্দ করা হয়।
অবশ্য তার আগেই ওই বছর ১৫ মে ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়া হয়। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি অবশ্য ব্রিটিশদেরই দেয়া। ‘১৯১৭ সালে যে মুহূর্তে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর জায়নবাদী আন্দোলনকে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জাতীয় আবাস গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিলেন, সেই মুহূর্ত থেকেই তিনি এক অশেষ সংঘাতের দ্বার খুলে দিলেন, যা শিগগিরই দেশটি ও তার জনগণকে গ্রাস করে। তার সরকারের নামে তিনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাতে বেলফোর অ-ইহুদি জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা সুরক্ষারও প্রতিশ্রুতি দেন, যা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রতি এক অদ্ভুত মনোভাবের প্রকাশ। কিন্তু এই ঘোষণা ফিলিস্তিনিদের জাতিসত্তা ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও জন্মগত অধিকারের সঙ্গে পরিষ্কারভাবে সংঘাতপূর্ণ।
অর্থাৎ ব্রিটেনের অধিকারে আসার আগ পর্যন্ত ইহুদিরা ছিল ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬ শতাংশ। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশদের ‘বেলফোর ঘোষণা’র পরই ইউরোপ ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে দলে দলে ফিলিস্তিনে আসতে শুরু করে ইহুদিরা। এরপর দ্রুতই বাড়তে থাকে তাদের সংখ্যা। সন্ত্রাস, গুপ্তহত্যা, হামলা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করতে থাকে। সেইসঙ্গে একের পর এক ফিলিস্তিনি গ্রাম ও শহর দখল করতে থাকে।
এভাবে ফিলিস্তিনের মূল ভূখণ্ডের বিশাল একটা অংশের পূর্ণ দখল নিশ্চিত করে ১৯৪৮ সালে ‘ইসরাইল রাষ্ট্র’র ঘোষণা দেয়া হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত ইহুদিবাদী বাহিনী কমপক্ষে সাত লাখ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনিকে ভিটেমাটি ছাড়া করে। দখল করে নেয় ফিলিস্তিনের মোট ভূখণ্ডের ৭৮ শতাংশ। অবশিষ্ট ২২ শতাংশ আজকের পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা।
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনে বাঁধা কী কী?
শান্তি চুক্তির জন্য ফিলিস্তিনিরা চায় ইসরায়েল যেন একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকার করে নিতে। এতে হামাসও থাকবে। গাজার ওপর থেকে অবরোধ তুলে নিতে হবে। পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুসালেমে ফিলিস্তিনেদের চলাফেরার ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নিতে হবে। অন্যদিকে ইসরায়েলের দাবি হচ্ছে, এজন্য আগে সব ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীকে সহিংসতার পথ ত্যাগ করতে হবে এবং রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে হবে।
এরপর রয়েছে সীমানা এবং ভূমি নিয়ে বিরোধ। আছে ইহুদী বসতি এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ইসরায়েলে ফিরে যাওয়ার অধিকারের প্রশ্ন। কিন্তু আরব এবং ইসরায়েলিদের মধ্যে অনেক যুদ্ধের পর বিরোধপূর্ণ অঞ্চলগুলোর সীমানা পাল্টে গেছে। ইসরায়েল যেহেতু অধিকৃত অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণে, তাই এর ভিত্তিতেই দরকষাকষি করতে চায় তারা। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা দাবি করছে, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগে যে সীমানা ছিল, সেই সীমানার ভিত্তিতেই তাদের রাষ্ট্র হবে। আর পশ্চিম তীরে ইসরায়েল যে অবৈধ বসতি নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে, সেটা নিয়ে সমস্যা তো আছেই।
আরও আছে জেরুসালেম নিয়ে দ্বন্দ্ব। পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণে থাকা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাস, উভয়েই চায় পূর্ব জেরুসালেম হবে তাদের ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী। যদিও ইসরায়েল ১৯৬৭ সাল হতে এটি দখল করে রেখেছে। এই বিরোধের নিরসন ছাড়া হয়তো একটা চূড়ান্ত সমাধান কোনদিনই সম্ভব হবে না। অন্যান্য বিরোধের ক্ষেত্রে হয়তো আপোসের জায়গা আছে, কিন্তু জেরুসালেমের বেলায় নেই।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৮০১
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ