যে সময়টাকে ইসলামের গোল্ডেন এইজ বলা হয়, অষ্টম শতকের মাঝামাঝি থেকে তেরো শতকের মাঝামাঝি অব্দি, যে সময়টাকে মনে করা হতো ইন্টেলেকচুয়ালি ইসলাম সমস্ত সংকীর্ণতাকে উতরাতে পেরেছিল, ওই সময় সমকামিতার প্রতি ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আলাদা। সমকামিতা নিয়ে তখন খোলাখুলি আলাপ করা হতো, লেখা হতো। আবু নুয়াস (৭৫৬-৮১৪) আব্বাসীয় খিলাফতের সময়ের অন্যতম গ্রেইট আরব ক্লাসিকাল পোয়েট ছিলেন। ওই সময়ে তার সমকামি কামনা ও প্রেম, খুব সুন্দর করে তার লেখায় ধরা দিয়েছিল। এমনকি বিংশ শতাব্দিতে এসেও তার হোমোইরোটিক কবিতাগুলার প্রচার করা হতো।
নুয়াস খুব গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক চরিত্র। দ্য বুক অব ওয়ান থাউজ্যান্ড এন্ড ওয়ান নাইটস সংকলনেও (উর্দুতে আলিফ লায়লা নামে পরিচিত) তার একাধিক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ২০০১ সালে আরবেরা নুয়াসের হোমোইরোটিজমের প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব দেখাতে শুরু করে। এরপর ওই সালেই মিশরের মিনিস্ট্রি অব কালচার ফ্যানাটিক ইসলামিস্টদের চাপে তার কবিতার ৬ হাজার ভলিউম পুড়িয়ে দিতে একপ্রকার বাধ্য হয়।
এ কারণেই সমসাময়িক মুসলিমরা ইসলামের গোল্ডেন এইজ সম্পর্কে তেমন কিছু জানেই না। যদিও তারা সেই যুগে ফিরত চায়। তারা জানেই না, মুসলিম সমাজে একটা সময়ে সমকামিতা নিয়ে আলাপ করা হয়েছে, এমনকি উদযাপনও করা হয়েছে। মাহমুদ গজনভি, যিনি ৯৯৭ থেকে ১০৩০ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পূর্ব ইরানীয় ভূমি এবং ভারত উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিম অংশ জয় করেন, তাকে আদর্শ হিসাবে দেখান যেতে পারে। ঐতিহাসিক সূত্র মতে, তিনি মালিক আয়াজ নামের এক ব্যক্তির সাথে গভীরভাবে প্রেমে ছিলেন। মুঘল সম্রাট বাবর ক্যামপ বাজারের এক বালকের প্রতি তার প্রেমের কথা ১৬ শতকে লেখা আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন। এই বইটা মধ্যযুগীয় মুসলিম বিশ্বের মহান সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়।
১৮ শতকে দরঘা কুলি খান, তার জার্নাল ‘দ্য দিল্লি এ্যলবামে’ লিখেছেন ইন্দো-ইসলামিক সমাজে কীভাবে সমকামিতা জায়গা করে নিয়েছিল। বাজারে, পুরুষ প্রস্টিটিউটেরা খোলাখুলিভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং খান প্রশংসা করে লিখছেন, যুবক সুদর্শনেরা সারাজায়গায় নৃত্য পরিবেশন করছে এবং তাদের ঘিরে সৃষ্টি হচ্ছে উন্মাদনার।
উনিশ শতক অব্দি মুসলমানেরা সমকামিতারে জীবনে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেই নিয়েছিল। সাদীর ক্লাসিক ‘গুলিস্তান’-এ পুরুষদের মধ্যকার প্রেম নিয়ে বলা হয়েছে যা কিনা পারসিয়ান শিক্ষার্থীদের অবশ্যপাঠ্য ছিল।
যদিও কয়েক দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্য সমকামিতাকে অপরাধ এবং পাশ্চাত্য থেকে এর ধ্যানধারণা নেয়া বলে অভিযোগ করে আসছে। এই আলাপে পরে আসছি। যদিও অনেক সমকামী এক্টিভিস্টই এই দুইটা অভিযোগকে অস্বীকার করছে বেশ আগে থেকেই। সমকামিতার ধারণা যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি থেকে নেয়া, এই ব্যাপারটা মূলত গোড়া ইউরোপিয়ানদের তৈরি করা সত্য বলে মনে করেন এই এক্টিভিস্টরা এবং তার যথেষ্ট কারণও আছে। ইতিহাস জটিল এবং কুসংস্কারের আছে প্রাচীন শেকড়। তবুও এক্টিভিস্টরা ইসলামিক শাসনের এমন এক সময়ের প্রতি ইঙ্গিত করেন, যখন আরব শাসকরা অনেক বেশি মুক্তমনা ছিল সেক্স নিয়ে। নবম শতকে বাগদাদের খলিফা আমিনের একজন পুরুষ প্রেমিক ছিলেন এবং তিনি সমকামী কবিদের সাথে খাবার গ্রহণ করতেন। তারা ক্লাসিক্যাল জেনার মুজুন অথবা হেডোনিস্টিক স্মাট থেকে কবিতা পড়তেন।
‘অ্যা প্রমেনাড অব দ্য হার্টস’, আহমেদ আল-তাফাশি, তেরো শতকের একজন আরব সেক্সলজিস্ট। তার দাবি, পুরুষাঙ্গের আকৃতি ভ্যাজাইনাল পেনিট্রেশনের থেকে এ্যানাল সেক্সের জন্য অধিক উপযুক্ত। এদিকে অধিকাংশ ক্লাসিক এবং অটোম্যান কবিতা পুরুষ প্রেমিকদের নিয়ে লেখা, আবার এখনকার দিনে এসে সমকামীরা অতীতের লেসবিয়ান কবিতাও আবিষ্কার করছেন। তখনকার দিনে লেখা একটা শ্লোক—
“How much have we grinded sister, ninety pilgrimagesMore delightful and invisible than the entries of the penis head”
সমকামী পোয়েট্রিই একমাত্র শিল্প না যা চলমান রেনেসাঁসের অংশ। মুহাম্মদ ইসাউই, যে নিজেকে ‘অ্যা কুইর ড্যানসার’ বলেন, কাইরো এবং বেইরুটে মেল বেলি ড্যানসারদের ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন। সে শুধুমাত্র অন্তর্বাস পরে তিউনিসিয়ার ক্লাব ও থিয়াটারে পারফর্ম করেছেন। তিনি বলেন, ‘পুরুষের জন্য তার মেয়েলি দিক প্রকাশ করা খুব স্বাভাবিক, এটা শিল্প, এটা আনন্দ।’
মুসলিম সমাজ এখনও বিশদভাবে পিতৃশাসিত। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে স্বাভাবিকভাবেই পুরুষালী স্বভাবের প্রশংসা করা হয়। এছাড়া, পুরুষের সৌন্দর্যের বন্দনা করায় কোন পাপ নেই। কুরআনে বেহেশত সম্পর্কে শুধু ৭২ জন কুমারী হুরের কথাই বলা নেই, সেখানে কিছু সুদর্শন যুবকের কথাও বলা হয়েছে যারা অবিরাম নন-এ্যালকোহলিক পানীয় পরিবেশন করবে। হ্যাঁ, অবশ্যই একই লিঙ্গের প্রেম সবসময় প্লেটোনিক পর্যায়ে থাকে না। ঐতিহাসিকভাবে, মুসলিম সমাজ তা স্বীকারও করেছে। অনুমোদন না দিলেও তারা একটা পর্যায় অব্দি তা সহ্যও করেছে।
কুরআনের সাতটি পৃথক আয়াতে সডোম ও গোমরাহর কাহিনীর মাধ্যমে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে শহরের অধিবাসীরা নবী লূতের কাছে ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত বার্তাবাহকদের নিকট যৌন প্রবেশাধিকার দাবি করেছিল। কুরআন এটিকে বিশ্বের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘৃণ্য কর্ম বা ফাহিশা বলে অভিহিত করেছে।
তবে কুরআনে কেবলমাত্র একটি অনুচ্ছেদে কঠোরভাবে এ ব্যাপারে আইনগত অবস্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি মূলত সমকামী আচরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং সামগ্রিকভাবে জিনা (অবৈধ যৌন মিলন) এর প্রতি নির্দেশ করে। আবার এর শেষ অংশে বলা হয়েছে—
“অতঃপর যদি উভয়ে তওবা করে এবং নিজেদের সংশোধন করে, তবে তাদের থেকে হাত গুটিয়ে নাও। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, দয়ালু।”[৪:১৫–১৬]
কুরআন বলছে, পুরুষেরা একে অন্যের সাথে সঙ্গম করলে, তাদের শাস্তি দেয়া হবে। তবে কীভাবে, তা বলেনি। বলা হয়েছে, যদি তারা অনুতপ্ত হয়, তাহলে তাদের পরিত্যাগ করতে হবে। সমকামিতায় মৃত্যুদণ্ড নবী মুহাম্মদের (স) উদ্ধৃতিতে পাওয়া যায়। এখানেও শাস্তির তারতম্য আছে। তবে মৃত্যদণ্ডটাকেই শাস্তি হিসাবে নিয়েছে মুসলিম সমাজ। আইএসআইএস মূলত জানেই না খিলাফতের সময়টাকে ফিরায়ে আনা আসলে কী! বাগদাদ মঙ্গলদের আক্রমণে ধ্বংসের আগে প্রায় গোটা পৃথিবীর কেন্দ্র ছিল। যেহেতু নুয়াস ও তার সময়কার কবিরা বাগদাদি কালচারের প্রতিনিধিত্ব করছে ওইসময়, তাহলে ধরা নেয়া যায়, বাকি বিশ্বেও সমকামিতা অপরাধ হিসাবে গণ্য হতো না। অথচ খিলাফতের পুনরুত্থানের নামে এই মৌলবাদিরা সমকামিদের ছাদ থেকে ফেলে দিচ্ছে। মারা না গেলে, আবার ফেলছে। এবং পৈশাচিকতারে ধর্ম হিসেবে দেখাচ্ছে সারা বিশ্বে। আর পশ্চিমারা তাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছে। গোঁড়া এবং মূর্খ ধর্মান্ধরা মূলত নিজেদের জন্য গর্ত খুঁড়ছে এভাবে।
এবার আসি ইসলামে হোমোসেক্সুয়ালিটি নিয়ে দুরকম প্রতিবেশ সৃষ্টির কারণে। এর পেছনে দুটি কারণ পাওয়া যায়। প্রথমটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুসলিমদেশগুলোতে ইউরোপিয়ান শাসন এবং ব্রিটিশদের পেনাল কোড আইন। ৭০ টিরও বেশি মুসলিম দেশের অর্ধেকই ব্রিটিশ কলোনিয়ালিজমের ছাঁকনিতে সমকামিতাকে অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করছে। একই সময়ে ফ্রান্সও একই আইন প্রবর্তন করে। এক্ষেত্রেও স্বাধীনতার পর জর্ডান ও বাহরাইন ছাড়া আর কেউ এই আইন বাতিল করতে পারেনি।
১৮৫৮ তে দ্য অটোমান এম্পায়ার ঘোষণা দেয় সমকামিতা অপরাধ নয়। এটা ব্রিটিশ শাসনে ইন্ডিয়ান পেনাল কোড, সেকশন ৩৭৭ প্রণয়নের দুই বছর আগের ঘটনা। অথচ এই আইনে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সমকামিতা নিষিদ্ধ ও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ক্যান ইউ ইমাজিন? পশ্চিমাদের আইনে আমরা সমকামিতারে ইসলামের অপরাধ হিসাবে মেনে আসছি, হত্যা করছি আমাদের কাছের মানুষদের, অসুস্থ বলে দাবি করছি, এড়িয়ে যাচ্ছি।
১৮৬০ সালের এই পেনাল কোড কনজার্ভেটিভ হিন্দুদের মধ্যেও এতটাই গেঁড়ে বসছিল যে স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও পার্লামেন্ট এই আইন বদলাতে সাহস করেনি। এতে এটাই দৃশ্যমান হয়, মুসলিম কনজার্ভেটিভেরা (এবং হিন্দুরা) কিছু না জেনেই মূলত ১৯ শতকের কলোনিয়ালিজমের ভিক্টোরিয়ান আচার-আচরণ অনুসরণ করছে, এমনকি নিজেদের ইতিহাস অস্বীকার করছে।
আর একটা ইন্টারেস্টিং কোএন্সিডেন্স দেখা যাক— এখনও পাঁচটা মুসলিম দেশে সমকামিতা অপরাধ নয়। এই দেশগুলো হইল মালি, জর্ডান, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক এবং আলবেনিয়া। পার্থক্যটা কই? পার্থক্য হলো কলোনিয়াল শাসনে। এই পাঁচটা দেশ কখনওই ব্রিটিশদের দ্বারা কলোনাইজড হয়নি।
দ্বিতীয়ত, ১৯৮০ তে যখন ইসলামিক মৌলবাদের উত্থান হয়, ওই সময়ে আমেরিকা ও ইউরোপে সমকামিদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন হচ্ছিল। যা এই দুই সমাজের কালচারাল বনিবনা না হওয়াকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। হিজবুল্লার (লেবানন কেন্দ্রিক ইসলামিস্ট পলিটিক্যাল গ্রুপ) নেতা হাসান নাসরুল্লাহ দাবি করেন পশ্চিমারা ষড়যন্ত্র করে মুসলিম দেশগুলোতে সমকামিতা এক্সপোর্ট করছে (অথচ সমকামিতা মুসলিম সমাজের বহু পুরানো চর্চিত বিষয়, যা পরবর্তীতে প্রগতিশীলতার মুখপাত্র হয়ে উঠছে)। যার ফলে ফ্যানাটিক ইসলামিস্টদের চোখে সমকামিতা পশ্চিমাদের ইসলামের পবিত্রতা নস্যাৎ করার উপায় হিসেবে থেকে গেছে।
আর ইউরোপীয় কলোনিয়ালিজমের পলিটিক্যাল ও কালচারাল ইজমের উত্তরাধিকার সূত্র থেকে সমকামিতার প্রতি মুসলমানদের মধ্যে এসেছে বিদ্বেষ। অধিকাংশ কনটেম্পোরারি মুসলিম, শুধু ফ্যানাটিক ইসলামিস্টরাই নয়, সমকামিতাকে পশ্চিমা সংস্কৃতির বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে দেখেন। শুধু এই কারণেই অনেকে সমকামী মানুষদের অধিকার নিশ্চিতে সচেতন নন, তা আপন সন্তান হলেও।
তথ্যসূত্র:
- Homosexuality in Islam: A Difficult Paradox- Nicole Kligerman
- https://amp.scroll.in/article/810093/orlando-shooting-its-different-now-but-muslims-have-a-long-history-of-accepting-homosexuality
- https://amp.economist.com/open-future/2018/06/06/how-homosexuality-became-a-crime-in-the-middle-east
- https://amp.theguardian.com/world/2016/jun/21/gay-lgbt-muslim-countries-middle-east
- https://www.haaretz.com/middle-east-news/islam-and-homosexuality-what-does-the-koran-say-1.5395747
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৪৩
আপনার মতামত জানানঃ