দিল্লির প্রাণকেন্দ্রে ২০ হাজার কোটি টাকা বাজেটের সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রজেক্ট। প্রধানমন্ত্রী, উপরাষ্ট্রপতির নতুন বাসভবন ছাড়াও নতুন সংসদ ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা হয়েছে এই প্রকল্পে। ইতিমধ্যেই জরুরি পরিষেবা তকমা পেয়েছে। পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্রও পেয়ে গেছে। এদিকে দেশটিতে তান্ডব চালাচ্ছে করোনা। প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। অক্সিজেন, বেডের ঘাটতি কমাতে হিমশিম খাচ্ছে রাজ্যগুলো। রাজধানী দিল্লির অবস্থাও আশঙ্কাজনক। এমন পরিস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদি সরকারের উচ্চাভিলাষী সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রজেক্ট আবারও স্পটলাইটের নিচে চলে আসল।
এদিকে, এই মেগাপ্রজেক্টে সম্প্রতি, দ্য সেন্ট্রাল পাব্লিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট ইন্ডিয়া গেটের কাছে কনস্ট্রাকশন সাইটে ছবি তোলা ও ভিডিও করা নিষিদ্ধ করেছে। দ্য সিপিডাব্লিউডি কনস্ট্রাকশন সাইটে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে, ‘নো ফটোগ্রাফি, নো ভিডিও রেকর্ডিং’।
সেন্ট্রাল ভিস্তা রিকনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট কী?
আলিশান সেন্ট্রাল ভিস্তা রিকনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট ভারতের রাজধানী দিল্লির মাঝামাঝি নেতা-মন্ত্রী-আমলাদের জন্য তৈরি এক সুবিশাল কমপ্লেক্স। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ইন্ডিয়া গেট এই তিন কিলোমিটার রাস্তাটিকে বরাবরই সেন্ট্রাল ভিস্তা বলা হয়। এই অংশটুকুর মধ্যেই আছে সাউথ ব্লক, নর্থ ব্লক, আমাদের দেশের পার্লামেন্টের মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভবন।
এই সেন্ট্রাল ভিস্তার অন্যতম মূল আকর্ষণ হল এখানে একটি নতুন পার্লামেন্ট বিল্ডিং তৈরি হবে। একটি সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং-ও তৈরি হবে। প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটি নতুন বাসস্থান। প্রধানমন্ত্রীর একটি নতুন অফিস যাকে পিএমও বলা হয়। ভাইস প্রেসিডেন্টের থাকার জন্য একটি মহল। একটা সুন্দর সাজানো গোছানো পার্ক ছাড়াও আরও বহু নতুন নতুন ভবন ও নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে এখানে।
এদিকে, পুরোনো সংসদ ভবনের পাশেই নতুন পার্লামেন্ট তৈরি করা হবে। কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরের পর গোলাকার বর্তমান পার্লামেন্ট হাউসটি তৈরি হয়। কিন্তু প্রস্তাবিত নতুন সংসদ ভবন হবে ত্রিকোণ আকৃতির। চারতলা হবে ভবনটি। অনেকে এর শেপকে তাই পেন্টাগনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ভূমিকম্প প্রুফ নতুন ঝাঁ চকচকে এই পার্লামেন্টে রাজ্যসভা, লোকসভা মিলিয়ে মোট ৯০০ থেকে ১২০০ জন সাংসদ বসতে পারবেন।
এই নতুন পার্লামেন্টের ইন্টিরিয়রের থিম হবে মূলত তিনটি জাতীয় প্রতীক ধরে। পদ্ম, ময়ূর এবং বটবৃক্ষ। গোটা বিল্ডিংটির এআই নির্ভর সিকিউরিটি সিস্টেম হওয়ার কথা। নতুন ধরনের অডিয়ো-ভিস্যুয়াল কমিউনিকেশন সিস্টেম ইনস্টল করা হবে নতুন পার্লামেন্টে। পেপারলেস রাখার জন্য বহু ডিজিটাল ইন্টারফেস ব্যবহার করা হবে এখানে। পেপারলেস এই পার্লামেন্ট তৈরির জন্য ওই এলাকার মোটামুটি ২০০ প্রাচীন গাছ কাটতে হবে। সরকার অবশ্য বলেছে, এর মধ্যে অনেকগুলি গাছকে তারা উপড়ে নিয়ে গিয়ে অন্যত্র বসাবে।
এই প্রোজেক্ট ২০২৪ এর মধ্যে শেষ করবে ইউনিয়ন মিনিস্ট্রি অব হাউজিং এন্ড আর্বান এফেয়ার্স। সেন্ট্রাল পাবলিক ওয়ার্কসের দেওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, নতুন সংসদীয় ভবন সম্প্রসারণের কাজ ২০২২ সালের নভেম্বরের মধ্যে শেষ করে ফেলার লক্ষ্যমাত্রা রাখা হচ্ছে। বলা হয়েছে, উপ–রাষ্ট্রপতির জন্য যে নতুন বাসভবন তৈরি হবে, সেটি ২০২২ সালের মে মাসের মধ্যে শেষ করে ফেলা হবে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর নতুন বাসভবন ও সেই সঙ্গে স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপের বিল্ডিংটি ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে শেষ করে ফেলা হবে।
আনুমানিক খরচ?
কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নেয়া এই পুরো সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রজেক্ট রিকনস্ট্রাকশনের জন্যই বরাদ্দ হয়েছে মোট ২,০০০ কোটি টাকা। এছাড়া, নতুন পার্লামেন্ট ভবনের জন্য খরচ পড়বে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা।
যা নিয়ে প্রায় প্রতিদিন কেন্দ্রীয় সরকার প্রধানমন্ত্রী মোদী বিরোধীদের সমালোচনার মুখে। বিরোধীদের যুক্তি, এমন নয় যে সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রজেক্ট পুরোপুরি বাতিল হয়ে যাক। বরং তারা বলার চেষ্টা করছেন, এখন দেশের যা পরিস্থিতি তাতে এই প্রজেক্ট স্থগিত রাখা হোক।
ওই টাকায় মানুষের প্রাণ বাঁচানো যাক, স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতি হোক। দেশের অর্থনীতি আবার একটা ভালো জায়গায় পৌঁছলে তবে এই প্রজেক্ট নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা হোক।
সুপ্রিম কোর্ট ও পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্র
সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি খান উইল করের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ ২-১ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রজেক্টকে ছাড়পত্র দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট নিজের রায়ে জানিয়েছে যে কেন্দ্র যে অধিকার ব্যবহার করেছে সেটা যথার্থ ও সঠিক। জমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে বদলগুলি করা হয়েছে সেটা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপত্তি নেই।
পরিবেশ রক্ষার্থে তৈরী কমিটির সুপারিশও যথার্থ বলে মনে করে আদালত। এদিন সুপ্রিম কোর্ট বলে যে স্মগ টাওয়ার তৈরী করতে হবে এই প্রকল্পের আওতায় দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বাড়ি নির্মাণে পরিবেশবান্ধব মালমসলা ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। ব্যবহার করতে হবে অ্যান্টি স্মগ গান নির্মাণকাজের সময়। ভবিষ্যতে এরকম কোনও প্রকল্প হলে পরিবেশমন্ত্রককে অনুরূপ নির্দেশ জারি করতে হবে বলে জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
এদিকে, আগামী বছরের মধ্যে উপ–রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নতুন বাসভবন তৈরি হয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের বিশেষজ্ঞ কমিটি সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পের অধীনে দুই বাসভবন, কমন সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট এবং স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপের বিল্ডিং তৈরিরও ছাড়পত্র দিয়েছে।
কেন এই প্রজেক্ট নিয়ে এত বিরোধিতা?
একদিকে ২ হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট। অন্যদিকে গোটা ভারত জুড়ে আছড়ে পড়েছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। বিশেষত, রাজধানী দিল্লির অবস্থা শোচনীয়। অক্সিজেন-ওষুধ নেই, চারিদিকে মৃত্যুমিছিল। বাধ্য হয়ে লাগাতার লকডাউনের পথে হেঁটেছেন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। আর দিল্লিতে কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্প’-এর কাজ চলছে রমরমিয়ে। যা নিয়ে সমালোচনার ঝড় যেমন উঠেছে দেশটিতে।
দেশটিতে হাসপাতাল নেই, হাসপাতালে বেড নেই, অক্সিজেন নেই, ওষুধ নেই। এই অবস্থায় এই প্রজেক্টে খরচ হওয়া টাকা দিয়ে মোটামুটি ৭ লক্ষ আইসিইউ ভেন্টিলেটর, ১৩ লক্ষ পোর্টেবল ভেন্টিলেটর কেনা যেত। তৈরি করা যেত অক্সিজেন প্ল্যান্ট।
হাসপাতাল তৈরির ক্ষেত্রে দিল্লিতে একটি হাসপাতাল তৈরি করতে মোটের উপর ১৫০ কোটি টাকা খরচ হয়। সেই হিসেবে সারা দেশে মোটামুটি ১৩০টি হাসপাতাল তৈরি করা যেত।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির স্বপ্নের প্রকল্প এই সেন্ট্রাল ভিস্তা। এই প্রকল্পের অন্তর্গত রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নতুন বাসভবনও। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সেই নির্মাণ শেষ হয়ে কথা। তাই লকডাউনের মধ্যেও জোরকদমে চলছে তার কাজ।
প্রসঙ্গত, এই সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পের সম্ভাব্য লগ্নি প্রায় কুড়ি হাজার কোটি টাকা। বিরোধীরা যা নিয়ে সরব হয়েছেন। এ নিয়ে প্রিয়াঙ্কা গান্ধি লিখেছেন, ‘সরকারি অর্থের সমস্ত করোনা আক্রান্তদের সেবায় খরচ না করে সরকার প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের বাড়ি বানাচ্ছে।’
এই কাজে অর্থ ব্যয় না করে দারিদ্রসীমার নীচে থাকা ব্যক্তিদের ন্যূনতম আয় সুনিশ্চিত করতে বলেছেন রাহুল গান্ধি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তাতে নারাজ। আদালতে কেন্দ্রের যুক্তি, পুরনো ভবনগুলির অবস্থা ভালো নয়, তাই শীঘ্র নতুন ভবন দরকার।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫৩৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ