ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে সুন্দরবনের ভেতরে এখন বুক সমান পানি। জলোচ্ছ্বাসে পানির চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। ধীরে ধীরে এই চাপ বাড়ছে। প্রাণ রক্ষায় বাঘ, হরিণসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী উঁচুস্থানে আশ্রয় নেওয়ার জন্য ছোটাছুটি করছে। কিছু বাঘ এবং হরিণ উঁচু স্থানে আশ্রয়ও নিয়েছে।
এদিকে প্রাণ বাঁচাতে মঙ্গলবার (২৫ মে) দিবাগত রাত ১২টায় হঠাৎ এক ছোট্ট হরিণ শাবককে নিয়ে দুটি হরিণ সাঁতরে উঠে আসে সুন্দরবনের দুবলার চর বন অফিস সংলগ্ন সাইক্লোন শেল্টারে। হরিণ শাবকের বয়স প্রায় তিন মাস। সাঁতরে আসার কারণে শরীর কাঁপছিলো থরথর করে। এ অবস্থায় পরম মমতায় মা হরিণটি শাবকের গা চেটে দিচ্ছিলো।
বুধবার (২৬ মে) দুবলার চর জেলেপল্লীর এ-ও তানভীর হাসান ইমরান নিজের ফেসবুক পোস্টে এসব তথ্য জানান।
পোস্টে তিনি লেখেন, সারারাত শাবকসহ হরিণটি আশ্রয়কেন্দ্রেই ছিল। হরিণ সাধারণত নিজের পেটের কোনও আওয়াজ পেলেও ভয়ে দৌড় দেয়, এত ভীতু প্রাণী। কিন্তু এই অসহায়ত্ব আজ ওদের সাহস জুগিয়েছে, মানুষের সংস্পর্শে বেঁচে থাকার তাগিদে আশ্রয় নিতে এসেছে। যাই হোক ওদের ভাগ্য ভালো, অফিস পর্যন্ত সাঁতরে আসতে পেড়েছে। চারিদিকে পানি, কোথাও উঁচু জায়গা নেই। জানি না অন্য প্রাণীদের কী অবস্থা। এই করুণ পরিণতির জন্য এই নিষ্পাপ, নিরাপরাধ প্রাণীগুলো একটুও দায়ী নয়। দায়ী আমরা মানুষরা, বনভূমি দখল করে শহর গড়ছি। বড় বড় মিল কারখানা দিয়ে বায়ূমন্ডলের তাপমাত্রা বাড়াচ্ছি। বিশ্বনেতৃবৃন্দের যুদ্ধ বিগ্রহ নিয়ে যত আগ্রহ দেখি, পৃথিবীর উষ্ণতা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে ততটাই উদাসীনতা দেখি। খুব দেরি নেই, মানুষের পরিণতি হবে এই বণ্যপ্রাণীগুলোর মতো। প্রকৃতি অসীম শক্তিশালী, এর ক্ষতি করলে, সেও ছাড়বে কেন? আর সে যখন ধরবে…প্রকৃতির কাছে মানুষ বড় অসহায়।
এদিকে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বিপর্যস্ত পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা। এর মধ্যেই বন থেকে একটি বাঘ বেরিয়ে এসেছে লোকালয়ে। ফলে আতঙ্ক ছড়িয়েছে জেলার কুলতলির মৈপিট উপকূল থানা এলাকায়।
আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে বলা হয়, বুধবার সকালে লোকালয়ে বাঘ দেখতে পান কিছু বাসিন্দা। এর ফলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। খবর পেয়ে জাল ও ট্র্যাঙ্কুলাইজার বন্দুক নিয়ে রওনা দেন কুলতলির বন বিভাগের কর্মীরা। তবে সকাল ১১টা পর্যন্ত বাঘটিকে বাগে আনা যায়নি বলে খবর পাওয়া গেছে।
সুন্দরবনের কটকা, কচিখালি, কয়রা, আংটিআরা এবং বগি এলাকায় কর্তব্যরত ফরেস্ট গার্ড ও বোর্ড চালকদের কাছ থেকে জানা গেছে, কটকা এবং কচিখালি এলাকায় কিছু হরিণ মারা গেছে। বাঘের মৃত্যুর খবর এখনও পাওয়া যায়নি। তবে বনরক্ষীদের ধারণা, দুর্বল এবং বয়স্ক বাঘসহ অনেক প্রাণী মারা যেতে পারে।
এসব বিষয় নিয়ে সুন্দরবনে কর্মরত এসিএফ জয়নাল আবেদীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাভাবিকের চেয়ে পানির চাপ পাঁচ থেকে ছয় ফুট বেশি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
কচিখালিতে কর্তব্যরত এক ফরেস্ট কর্মকর্তা জানান, কচিখালি বেরিবাঁধ ভেঙে গেছে। গাছপালা ভেঙেছে প্রচুর। ট্রলারসহ অন্যান্য যান বেঁধে রাখার জেটি ভেঙে গেছে। মৃত হরিণও দেখা গেছে বেশকিছু।
কটকায় কর্মরত একজন কর্মকর্তা জানান, জলোচ্ছ্বাসের কারণে নারিকেল ও শাল গাছ এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসবাসের স্থাপনাও ভেঙে গেছে। সুন্দরবনের ভেতরের পুকুর পাড় ভেঙে লবণ পানিও ঢুকেছে। এছাড়া সুন্দরবনের ভেতরে পর্যটকদের যাওয়ার জন্য ফুড ট্রেনও ভেসে গেছে। বিশুদ্ধ পানি রাখার ট্যাংক, সুন্দরী গাছসহ অন্যান্য গাছের মজুদ রাখা লট ভেসে গেছে।
তিনি আরও জানান, হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী আশ্রয় নিয়েছে পুকুর পাড়ের উঁচু জায়গায়। সেখান থেকে একটু দূরে আশ্রয় নিয়েছে বাঘ। যে পরিমাণের পানি বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে হরিণ, বাঘসহ অন্যান্য প্রাণী মারা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আরেকজন কর্মকর্তা জানান, প্রচণ্ড বাতাসের সঙ্গে পানির চাপ। এতে বসবাসের এলাকায় বাঁধের কিছু অংশ ভেঙে গেছে। সেই বাঁধ ধরে রাখার চেষ্টা চলছে।
সুন্দরবনের ভেতরে কয়েকজন ফরেস্ট গার্ড গিয়ে দেখেছেন, উঁচুস্থানে বাঘ আশ্রয় নিয়েছে। হরিণ গাছের ডাল জড়িয়ে বেঁচে আছে।
তারা জানান, কোনো উঁচু জায়গায় বাঘ আশ্রয় নিলে তার আশেপাশে অন্যান্য বন্যপ্রাণী আশ্রয় নিতে পারে না। তারা উঁচু গাছের ডালে মাথা রেখে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে থাকে। বাঘ উঁচু জায়গা খুঁজে না পেলে তারাও এভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে থাকে। এ সময় বনবিড়ালসহ অন্যান্য ছোট প্রাণী গাছের উপরে আশ্রয় নেয়। তাদের মতে, বড় জলোচ্ছ্বাস হলে বাঘ ও হরিণ বেশি মারা যায়।
সুন্দরবনের দুবলা জেলে পল্লী টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রহ্লাদ চন্দ্র রায় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সুন্দরবনের দুবলায় ৫ ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। দুবলায় সকাল থেকেই প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়া বইছে। মাঝে মাঝে বৃষ্টিও হচ্ছে। দুবলা টহল ফাঁড়ির ১০জন ষ্টাফ দুবলা সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছেন। সুন্দরবনে অন্যান্য বন অফিসের সদস্যরাও সুন্দরবনের কোস্টগার্ডের আলোরকোল, কোকিল মনি, সুপতি ও ডুমুরিয়া ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে।
সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রানী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবির জানান, করমজল বন্যপ্রানী প্রজনন কেন্দ্রে এক থেকে দেড় ফুট পানি উঠেছে। আরো এক ফুট পানি উঠলেও এই প্রজনন কেন্দ্রের বন্যপ্রানী হরিণ, কুমির ও বিলুপ্তপ্রজাতির কচ্ছপ বাটাগুল বাচকা রক্ষা করা আমাদের জন্য সম্ভব হবে। পানি আরো বাড়লে বন্যপ্রানীগুলোর কি অবস্থা হবে তা বলা সম্ভব নয়।
এদিকে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আতঙ্কে সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা ও চাঁপাই রেঞ্চের ঝুকিপূর্ণ ৮টি অফিস বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ সকল অফিসে কর্মরত কর্মকর্তা ও বনরক্ষিসহ ৫০ জনকে নিরাপদে আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
এসব অফিসগুলোর মধ্যে রয়েছে শরণখোলা রেঞ্জের, দুবলা, ককিলমুনি, শ্যালা, কচিখালী ও চড়খালী টহলফাঁড়ি বন অফিস। চাঁদপাই রেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। তাম্বুলবুনিয়া, জোংড়া ও ঝাপসি টহলফাঁড়ি বন অফিস। বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি আরও বলেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ইয়াস আগামী ২৬ মে (বুধবার) বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানবে। বিষয়টি মাথায় রেখে সুন্দরবনে অবস্থান করা জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। আশা করছি, প্রতিবারের মতো এবারও সুন্দরবন নিজে বুক পেতে উপকূলবাসীদের নিরাপদ রাখবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪২৬
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ