বছর কুড়ি আগে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ আফগানিস্তানে সেনা পাঠান। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগলে জঙ্গি হামলার পর তালিবানদের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাতের সিদ্ধান্ত নেন বুশ। মূল লক্ষ্য ছিল আল-কায়দা জঙ্গি গোষ্ঠী ও তার মাথা ওসামা বিন লাদেনকে নিশ্চিহ্ন করা। লাদেনের প্রধান আশ্রয়দাতা তালিবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন বুশ। সেইসময় গোটা বিশ্বের সমর্থন পেয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বহু ক্ষয়ক্ষতি হয় আফগানিস্তানের।
প্রায় ২৪০০ মার্কিন সেনা নিহত হন তালিবানদের সঙ্গে যুদ্ধে। যুদ্ধের জেরে মার্কিন প্রশাসনের কোষাগার থেকে খরচ হয়েছে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে বাইডেনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন ডেমোক্র্যাটিক দলের সতীর্থরা। যদিও বিরোধী রিপাবলিকানদের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষা প্রশ্নের মুখে পড়বে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে আফগানিস্তান আক্রমণ করে তালেবান নেতৃত্ব উৎখাতের প্রায় ২০ বছর পর আগামী ১১ই সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করবে। যুক্তরাজ্যের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল নিক কার্টার সম্প্রতি বার্তা সংস্থা বিবিসিকে বলেন, এই সময়ে আফগানিস্তানে বিপুল পরিবর্তন এসেছে। নারীদের জীবনযাপন, শিক্ষা ও গণমাধ্যম ব্যাপক উন্নতির কথা বলেন তিনি।
সহিংসতা কতটা বেড়েছে?
যদিও জাতিসংঘের হিসাবে, এক বছর আগের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে আফগানিস্তানে বেসামরিক নাগরিক হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি। বেড়েছে নারী ও শিশুদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও। এসব ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তালেবানের মতো বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো দায়ী বলা হচ্ছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালে টানা সপ্তম বছর আফগানিস্তানে তিন হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। সেখানে সুশীল সমাজের সদস্য, গণমাধ্যমকর্মী, সরকারি কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে হামলার ঘটনাও বাড়তে দেখা গেছে।
২০১৯ সালের আগস্টজুড়ে আফগানিস্তানে সহিংসতার ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে বিবিসি দেখেছে, সেখানে দৈনিক গড়ে ৭৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
এর আগের বছর দেশটিতে নিহত হয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি- ৩ হাজার ৮০০ জন এবং আহত হয়েছিলেন সাত হাজারেরও বেশি মানুষ।
কেমন আছে আফগান নারীরা?
তালেবান শাসনে ১৯৯০ এর দিকে আফগানিস্তানে নারীরা বাইরে কাজ করতে পারত না। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল।
২০০১ সালে এ অবস্থায় পরিবর্তন আসে। দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থার তথ্য মতে, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে এখনও পুরুষের আধিক্য বেশি। তবে একই সাথে সব ক্ষেত্রেই নারীদের অংশগ্রহিণ বাড়ছে।
২০০৪ সালে মাত্র ৫১ হাজার ২০০ নারী এই ধরণের সেক্টরে কাজ করত। ২০১৮ তে এসে এই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৭ হাজারে।
কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের বৃদ্ধিও চোখে পড়ার মতো। তবে নারীদের তুলনায় তা বেশ কম। তবে কর্মক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা প্রায় ৬৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে পুরুষের সংখ্যা বেড়েছে ৪১ শতাংশ।
সাম্প্রতিক একটি মার্কিন প্রতিবেদন বলছে, গত কয়েক বছরে আফগানিস্তানে নারী পুলিশের সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। ২০০৫ সালে আফগান পুলিশে নারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৮০ জন, ২০১৯ সালে তা সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
এমনকি নারী বিচারকের সংখ্যাও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ২০০৭ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র শতাংশ। ২০১৮ তে তা দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে।
নারী শিক্ষার অবস্থা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে ০.৯ মিলিয়ন শিশু স্কুলে যেত। ২০১৭ সালে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৯.২ মিলিয়ন। যার মধ্যে ৩৯ শতাংশ মেয়ে।
প্রাথমিক শিক্ষার দিকে তাকালে জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী দেখা যায়, ২০১২ সাল থেকে স্কুলে মেয়েদের উপস্থিতি ৪০ শতাংশ বেড়ে যায়। যদিও বর্তমানে তা কিছুটা কমে গেছে।
২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে ইউনিসেফ জানায়, আফগানিস্তানে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার প্রবণতা এমনিতেই কম। দেশটির ৩.৭ মিলিয়ন শিশু স্কুলে যায় না। যার ৬০ শতাংশ মেয়ে।
ইউনিসেফ আরও বলেছে, আফগানিস্তানের বিশাল এলাকায়, বিশেষ করে তলেবান ও অন্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে স্কুলে মেয়েদের উপস্থিতির হার একেবারেই কম।
তবে দেশটির শিক্ষাখাতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। ২০১৮ সালে আফগানিস্তানে শিক্ষকদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই ছিলেন নারী। এছাড়া সেখানে নারীদের মধ্যে সাক্ষরতার হারও বৃদ্ধি পেয়েছে।
সরকারি তথ্য অনুসারে, ২০০২ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে দেশটির সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় সাতগুণ।
দরিদ্রতার কী পরিস্থিতি?
আফগানিস্তানের বিশ্বের অন্যতম দরিদ্রতম দেশ। তবে ২০০১ সালে মার্কিন সেনারা দেশিটি দখলের পর থেকে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তার পর্যাপ্ততার কারণে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত এগোতে থাকে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ২০০৩ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে গড়ে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে আফগানিস্তানে।
তবে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা কমার সঙ্গে সঙ্গে প্রবৃদ্ধির গতিও কমতে থাকে।
তার ওপর ২০১৫ সাল থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আফগান অভিবাসী দেশে ফিরতে শুরু করেন, যার ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বেশ কিছু সমস্যার মুখে পড়ে।
সরকারি জরিপে দেখা গেছে, আফগানিস্তানের ৫৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন, যাদের মাসিক আয় ২ হাজার ৬৪ আফগানিরও (আফগান মুদ্রা) কম।
অথচ ২০১১-১২ সালেও দারিদ্র্যের এই হার ছিল ৩৮ শতাংশের মতো।
২০১৯ সালের আগস্টে গ্যালাপের একটি জরিপ থেকে জানা যায়, ভয়াবহ খরায় আফগানিস্তানের খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতি ১০ জনের ছয়জনই জানিয়েছেন, তারা গত বছর খাদ্য জোগাড় করতে হিমশিম খেয়েছেন।
করোনাভাইরাস মহামারিতে সেই পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২২২৮
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ