টানা ১২ দিনের ভয়ঙ্কর সংঘর্ষের পর অবশেষে ইরান ও ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হঠাৎ করেই ঘোষণা দেন এই যুদ্ধবিরতির, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেককেই বিস্মিত করেছে। কারণ এই সংঘর্ষ ছিল শুধু দু’টি দেশের মধ্যকার নয়—এটি ছিল গোটা মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্ব শক্তির এক মারাত্মক টানাপড়েন। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও ইরানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, তাদের পরমাণু কর্মসূচির গন্তব্য, এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তা উদ্বেগ—সবকিছু মিলিয়ে প্রশ্ন উঠে এসেছে: ইরান এখন কী করবে?
এই প্রশ্নের পেছনে রয়েছে গভীর কূটনৈতিক এবং সামরিক বাস্তবতা। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি অনুযায়ী, তারা ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু স্থাপনায় সফলভাবে বোমা হামলা চালিয়ে কর্মসূচি ‘ধ্বংস’ করেছে। এর মধ্যে ফোর্দো নামের স্থাপনাটির স্যাটেলাইট চিত্রও প্রকাশ পায়। কিন্তু ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি একে ‘ব্যর্থ হামলা’ বলে অভিহিত করেছেন। বাস্তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে দ্বিধা তৈরি হয়েছে। কারণ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি শুধু ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানে সীমাবদ্ধ নয়। দেশটির পরমাণু অবকাঠামো অনেক বিস্তৃত, এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানকে কোনো বোমা দিয়ে ধ্বংস করা সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরান যেহেতু আগেই পরমাণু প্রযুক্তির মৌলিক জ্ঞান অর্জন করে ফেলেছে, তাই যতবারই তাদের স্থাপনা ধ্বংস হোক না কেন, তারা আবার তা গড়ে তুলতে সক্ষম। ইরান নিজেরাই বলছে, তারা কর্মসূচি বন্ধ করবে না। অথচ ইসরায়েল এবং পশ্চিমা বিশ্ব চায়, ইরান তাদের সামরিক পরমাণু সক্ষমতা পুরোপুরি বন্ধ করুক। এই অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে আসে: তাহলে কি ইরান এবার পরমাণু বোমা তৈরির দিকেই এগোচ্ছে?
এই প্রশ্নের উত্তর সরাসরি কেউ না দিলেও বেশ কিছু তথ্য এবং ইঙ্গিত বলছে, ইরান এই পথেই হাঁটতে পারে। বিশেষ করে তারা ইতোমধ্যে প্রায় ৪০০ কেজি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম লুকিয়ে ফেলেছে—যা দিয়ে প্রায় ১০টি পরমাণু বোমা তৈরি সম্ভব। আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা (IAEA) তাদের ওপর নজরদারি চালাতে চাইলেও, ইরানের সংসদ এক বিল পাস করেছে যাতে সংস্থাটির সঙ্গে সম্পর্ক স্থগিত করা হয়েছে। এতে করে ইরানের প্রকৃত পারমাণবিক সক্ষমতা বা অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, ইরান এখন উত্তর কোরিয়ার পথেই হাঁটছে। উত্তর কোরিয়া যেমন পরমাণু অস্ত্র বানিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের চোখ রাঙানির ভয়ে এক ধরনের নিরাপত্তার গ্যারান্টি পেয়েছে, তেমনি ইরানও পরমাণু অস্ত্রের দিকে গেলে হয়ত ভবিষ্যতে ইরাক বা লিবিয়ার মতো পরিণতির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। কারণ, ইরাক ও লিবিয়া পরমাণু অস্ত্র ছাড়তে গিয়ে আমেরিকার হামলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আর এই বাস্তবতা ইরানকে তার অবস্থান আরও কঠোর করতে বাধ্য করেছে।
তবে ইরানের বর্তমান বাস্তবতা আরও জটিল। যুদ্ধের পর তাদের সামরিক শক্তির দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে গেছে। আকাশ প্রতিরক্ষা কার্যকর ছিল না, এবং বেশ কিছু যুদ্ধবিমান ঘাঁটি থেকেই উড়িয়ে দেওয়া যায়নি। এই দুর্বলতা কাটাতে ইরান এখন চীন এবং রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছে। রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের SU-35 যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি অনেক আগেই হয়েছিল, এখন সেটা কার্যকরের পথে। পাশাপাশি চীনের কাছ থেকে আধুনিক রাডার, ড্রোন, আকাশ প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি এবং ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে আগ্রহী ইরান। কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো, ইরানের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটা ভালো কি?
এখানে ইরানের কৌশল ভিন্ন। তারা নগদ অর্থের বদলে তেল দিয়ে চুক্তি করতে চায়। তাদের রয়েছে বিশাল তেলের মজুত, যেটা তারা অস্ত্রের বিনিময়ে দিতে প্রস্তুত। এই বিনিময় পদ্ধতি ইরানকে নিষেধাজ্ঞার ফাঁদ এড়িয়ে অস্ত্র সংগ্রহের সুযোগ দেবে। যদিও চীন এবং রাশিয়া উভয় দেশই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে আছে, তবু তাদের সাথে গোপনে বা সীমিতভাবে এমন চুক্তি করা সম্ভব হতে পারে।
অন্যদিকে ইসরায়েলের হিসাবেও একটা মিল-অমিলের খেলা চলছে। ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করেছিল দুটি উদ্দেশ্যে: ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করা এবং তাদের সরকারকে অস্থিতিশীল করে শাসনব্যবস্থার পতন ঘটানো। বাস্তবে এর কোনোটাই সফল হয়নি। বরং ইরান এখন আগের চেয়ে আরও বেশি কঠোর এবং প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব নিচ্ছে। তবে ইসরায়েলের কিছু লাভ অবশ্যই হয়েছে। এক, তারা গাজার হামাস ইস্যু থেকে বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে। দুই, ইরানের মদদপুষ্ট হামাস ও হেজবুল্লাহকে দুর্বল করে দিয়েছে। তিন, আমেরিকাকে সরাসরি ইরানে বোমা মারার বিষয়ে রাজি করাতে পেরেছে।
তবে যুদ্ধবিরতি যে খুব একটা টেকসই হবে না, তা এখন স্পষ্ট। কারণ কোনো সমঝোতা হয়নি, নেই কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি। শুধু দু’পক্ষের হামলা বন্ধ আছে, সেটাই যুদ্ধবিরতি। এই পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞ মুরাত আসলান বলছেন, যুদ্ধবিরতি যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। যদি ইরান আবারও পরমাণু সক্ষমতা বাড়াতে থাকে, কিংবা তার ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি সৌদি আরব বা ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাকে অকার্যকর করে দেওয়ার অবস্থায় পৌঁছে, তাহলে ইসরায়েল অবশ্যই আবার হামলা করবে।
একই সঙ্গে ইসরায়েল চায়, ইরান যেন তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি সামরিকীকরণ থেকে সরে আসে। কিন্তু ইরান যেহেতু এই মুহূর্তে পরমাণু অস্ত্রকে নিরাপত্তার একমাত্র গ্যারান্টি হিসেবে বিবেচনা করছে, তাই তারা খুব সহজে এই দাবিতে রাজি হবে না। বরং তারা বিশ্বাস করে, কেবলমাত্র পরমাণু অস্ত্র থাকলেই ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে আর এমন হামলা চালানোর সাহস পাবে না।
সবশেষে বলা যায়, এই যুদ্ধবিরতি এক ধরনের বিরতি মাত্র। এটা শান্তির চুক্তি নয়, বরং বড় যুদ্ধের আগে একটু সময় নেওয়া। ইরান আপাতত নিজের সামরিক দুর্বলতা কাটাতে ব্যস্ত হবে, চীন-রাশিয়ার সহযোগিতা নিতে চেষ্টা করবে, এবং একই সঙ্গে নিজেদের পরমাণু কর্মসূচিকে আরও গোপনীয় এবং সুরক্ষিত করতে কাজ করবে। অন্যদিকে ইসরায়েল এবং পশ্চিমা বিশ্ব সেই সময়ের অপেক্ষায় থাকবে, যখন তারা আবারও প্রমাণ পাবে যে ইরান পরমাণু বোমা বানাতে যাচ্ছে। তখন হয়ত আবার শুরু হবে নতুন এক ধ্বংসযজ্ঞ।
আপনার মতামত জানানঃ