বাংলাদেশে আবারও এক নতুন ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিতর্কের জন্ম হয়েছে। চব্বিশের আন্দোলনে অংশ নেওয়া ‘জুলাই যোদ্ধা’ ও শহীদদের পরিবারকে সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা এবং আর্থিক ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত এখন অনেকের চোখে অদ্ভুত এক প্যারাডক্স বা দ্বন্দ্বের রূপ নিয়েছে। কারণ, এই আন্দোলনের অন্যতম চেতনা ছিল ‘কোটা সংস্কার’—যার বিরুদ্ধে তারা রাস্তায় নেমেছিল, যার জন্য তারা গুলি খেয়েছিল, শহীদ হয়েছিল, আজ সেই শহীদদের পরিবারই সেই ব্যবস্থার সুবিধাভোগী। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে তারা কি নিজেদের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গিয়েছেন? এই দ্বন্দ্ব কি শহীদের রক্তের সাথে একপ্রকার বিশ্বাসঘাতকতা নয়?
২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল বাংলাদেশে একটি যুগান্তকারী ছাত্র আন্দোলন। ছাত্রছাত্রীদের এই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল—মেধার ভিত্তিতে চাকরি নিশ্চিত করা, কোনো অযৌক্তিক কোটাব্যবস্থা নয়। তখনকার আন্দোলনের কেন্দ্রে থাকা অনেকেই এখন সরকারের স্বীকৃতি পেয়েছেন ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে। তাদের পরিবার পাচ্ছে আর্থিক ভাতা, সরকারি হাসপাতালে আজীবন চিকিৎসা, এবং সরকারি ও আধা-সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার। শহীদ পরিবার পাচ্ছে ৩০ লাখ টাকা এককালীন অনুদান ও প্রতি মাসে ভাতা। একে কেউ বলছেন ন্যায্য সম্মাননা, কেউ বলছেন নৈতিক আত্মঘাত।
ফারুক-ই-আজম, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা সম্প্রতি জানিয়েছেন, “জুলাই যোদ্ধারা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। তাদের ত্যাগের স্বীকৃতি দিতেই এই উদ্যোগ।” তিনি আরও জানান, তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে আহত যোদ্ধাদের মাসিক ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ক্যাটাগরি ‘এ’ এর যোদ্ধারা পাচ্ছেন ২০ হাজার, ‘বি’ ক্যাটাগরি পাচ্ছেন ১৫ হাজার এবং ‘সি’ ক্যাটাগরি পাচ্ছেন ১০ হাজার টাকা মাসিক ভাতা। শহীদ পরিবার পাচ্ছে চাকরির কোটা এবং মাসিক ২০ হাজার টাকা করে ভাতা।
কিন্তু এই প্রক্রিয়াতেই জ্বলে উঠছে বিতর্কের আগুন। ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সাবেক আন্দোলনকারী রায়হান হোসেন বললেন, “যে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমরা মুখ তুলেছিলাম, সেটা যদি আজ শহীদ পরিবার ভোগ করে, তবে আমাদের আন্দোলনের নৈতিকতা কোথায় দাঁড়ায়?” তার মতে, শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো উচিত, কিন্তু সেটা যেন শহীদের চেতনার বিরুদ্ধেই না হয়।
প্রশ্ন আরও ঘনীভূত হয়েছে যখন দেখা গেছে, এই ‘জুলাই যোদ্ধা’দের পুরাতন চেতনার জায়গা থেকে অনেকেই এখন চাকরি পাওয়ার লড়াইয়ে নিজেকে ‘কোটাধারী’ হিসেবে দাবি করছেন। অথচ, তারা তো এই ব্যবস্থারই সংস্কার চেয়েছিলেন! তাহলে কি তখনকার দাবি ছিল কেবল অন্যদের কোটার বিরোধিতা, নিজের জন্য সুবিধা নিশ্চিত করলেই সব ঠিক?
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আন্দোলন চিরকাল নৈতিক জায়গা থেকে হয় না, অনেক সময় তা রাজনৈতিক ও কৌশলগত। এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই দেখতে হবে যে, যারা শহীদ হয়েছেন, তারা পরিবারের জন্য কিছু রেখে যেতে পারেননি। রাষ্ট্র সেটা পূরণ করতে চাচ্ছে—এটা মানবিক। তবে একইসঙ্গে রাষ্ট্রকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যেন এই অনুদান বা কোটা সুবিধা আন্দোলনের মূল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক না হয়।”
বিরোধীদল ও স্বাধীন বিশ্লেষকরাও বলছেন, এই সুবিধাগুলো শহীদ পরিবার পেতে পারে, তবে ‘চাকরির কোটা’ হিসেবে নয়, বরং সমাজ কল্যাণমূলক পরিকল্পনার আওতায় যেন তাদের সহায়তা দেওয়া হয়। তাহলে শহীদদের মর্যাদা রক্ষা পাবে এবং নতুন কোনো বৈষম্যের জন্মও হবে না।
এখানে প্রশ্ন শুধু অর্থনৈতিক নয়, প্রশ্নটি হচ্ছে নৈতিকতা ও চেতনার। যখন কেউ রক্ত দিয়ে একটি অবস্থান তৈরি করে—মেধার ভিত্তিতে সকলের সমান সুযোগ, তখন সেই রক্তের মূল্যায়ন হতে পারে না কেবল সুবিধাভোগের মাধ্যমে। শহীদদের সম্মান যেন তাদের আদর্শকেই বাঁচিয়ে রাখে, তাদের নাম যেন ব্যবহৃত না হয় আরেকটি কোটাব্যবস্থার রাজনৈতিক মুখোশ হিসেবে—এটাই হোক এখনকার প্রজন্মের আবেদন।
জুলাই যোদ্ধাদের প্রতি সম্মান অটুট থাকুক, কিন্তু সেই সম্মান যেন তাদের স্বপ্নকে ভোলানো না হয়। কারণ, এই শহীদরা জীবন দিয়েছিলেন মেধা ও ন্যায়ের পক্ষে, প্রথা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে। সেই রক্ত আজ যেন আরেকটি রক্তচক্ষুর কারণে ব্যর্থ না হয়। এটা শুধুই অর্থের লেনদেন নয়, এটা একটা জাতির আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন।
আপনার মতামত জানানঃ