
সেকে (Seke) একটি বিলুপ্তপ্রায় ভাষা, যা মূলত নেপালের উত্তরের পাঁচটি গ্রামের মানুষ ব্যবহার করত। এখন এই ভাষার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে অবস্থিত কিছু উঁচু অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের ওপর—এই ভবনগুলো যেন হয়ে উঠেছে নতুন “উল্লম্ব গ্রাম”।
কিভাবে একটি অল্প পরিচিত, শুধু মুখে বলা হয় এমন ভাষা, যা ৭০০ জনের বেশি মানুষ ব্যবহার করে না, হিমালয়ের পাহাড় থেকে নিউইয়র্ক শহরের কংক্রিটে এল? রাশমিনা গুরুং, যিনি সেকের সবচেয়ে কমবয়সী ব্যবহারকারীদের একজন, তার দিদিমার কাছ থেকে গ্রামে ভাষাটি শিখেছিলেন। পরে তিনি কাঠমান্ডু ও সেখান থেকে নিউইয়র্কে চলে আসেন—যেখানে তিনি মনে করেন তাদের জাতিগোষ্ঠীর এক-চতুর্থাংশ মানুষ এখন বসবাস করছে। এখানেই হিমালয়, পশ্চিম আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার অনেক বিলুপ্তপ্রায় ভাষাভাষীরা এসে মিলিত হয়েছে। তারা নতুন করে গড়ে তুলেছে মিশ্র সংস্কৃতির এক শহর, যেখানে নেপালি, তিব্বতি, ইংরেজি আর তাদের নিজস্ব মাতৃভাষাগুলো একসঙ্গে ব্যবহার হচ্ছে।
নিউইয়র্ক শহর আজ পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভাষা বৈচিত্র্যময় নগরী। এখানে ৭০০-র বেশি ভাষা ব্যবহার হয়, যা গোটা বিশ্বের ভাষার ১০ শতাংশের বেশি। যদিও এই ভাষাগুলো অনেকটাই অদৃশ্য—বা বহিরাগতদের জন্য শুনতে অসাধ্য—তবুও এই শহরের দোকানপাট, সাইনবোর্ড ও রাস্তাঘাটে আপনি আরবি, হিন্দি, বাংলা, চীনা ও স্প্যানিশ ভাষার শব্দ খুঁজে পাবেন। কিন্তু এই বৈচিত্র্য এখন বিপদের মুখে। ভাষার উৎসস্থানগুলোতেই যেভাবে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে, নিউইয়র্কেও সে ধারা চলছে। অভিবাসন কঠিন হয়ে যাচ্ছে, শহরের জীবনধারা ব্যয়বহুল হচ্ছে, আর এর ফলে ভাষাভিত্তিক এই অনন্য মিলন-মেলা ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে।
এই সাংস্কৃতিক সংকটের প্রতিকারে কাজ করছে ‘এন্ডেঞ্জার্ড ল্যাংগুয়েজ অ্যালায়েন্স’, যার সহ-পরিচালক লেখক নিজেই। তারা শহরের ভাষাগত মানচিত্র তৈরি করছে। কারণ, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। অনেক ভাষা হারিয়ে যাবে, সেগুলো রেকর্ড করার আগেই।
তবে এই বিপদের মাঝেও রয়েছে সম্ভাবনার দরজা। ভাষাবিদ ও ভাষাভাষীরা এখন এমন এক সময়ে এসে পৌঁছেছে, যখন তারা একসঙ্গে হারিয়ে যেতে বসা ভাষাগুলো সংরক্ষণ করতে পারে। এসব ভাষা শুধু কথা বলার মাধ্যম নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িত থাকে স্বতন্ত্র শিল্প, সংগীত, খাবার ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি—যা বিশ্বব্যাপী ভাবনার খোরাক যোগায়।
নিউইয়র্কের কুইন্সে বাস করা নাহুয়াতল ভাষাভাষী কবি ও রাঁধুনি ইরউইন সানচেজ তাঁর রান্নায় (যেমন টাকো, মোল, তামালে) ব্যবহার করেন সেই শব্দগুলো, যেগুলো এসেছে আজটেক সভ্যতা থেকে। তাজিকিস্তানের ওয়াখি ভাষাভাষী হুসনিয়া শিশুদের জন্য বই লিখছেন, ছয়টি বিলুপ্তপ্রায় পামিরি ভাষায়। গিনির ইব্রাহিমা ত্রাওরে ‘এন’কো’ নামের এক পশ্চিম আফ্রিকান লিপির শিক্ষক, যিনি এই লিপিকে প্রযুক্তিতে ব্যবহারযোগ্য করার চেষ্টা করছেন। ইয়িদ্দিশ লেখক বোরিস স্যান্ডলার, মলদোভায় জন্ম নেওয়া একজন উপন্যাসিক, যিনি ধারাবাহিকভাবে নিউইয়র্কে ইয়িদ্দিশ ভাষার পুনর্জাগরণে ভূমিকা রাখছেন।
লেনাপে, অর্থাৎ নিউইয়র্ক শহরের আসল ভূমিপুত্রদের ভাষাটিও ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। বর্তমানে এটি কানাডার অন্টারিওতে একমাত্র স্থানীয় বক্তার মাধ্যমে বেঁচে আছে। কিন্তু কিছু ভাষাকর্মীর উদ্যোগে এটি আবারও শেখানো হচ্ছে। কারেন মোসকো নামের একজন কর্মী, যিনি মৃত্যুর আগে প্রতি মাসে একবার নিউইয়র্কে এসে লেনাপে শেখাতেন, বলতেন যে ম্যানহাটনের লেনাপে অর্থ হলো “যেখানে তীর বানানো হয়।”
আবার ফিরে আসা যাক সেকে ভাষাভাষী রাশমিনার কথায়। গত সাত বছর ধরে তিনি নেপাল ও নিউইয়র্ক—দুই জায়গায় সেকে ভাষা রেকর্ড করেছেন, অনুবাদ করেছেন, ট্রান্সক্রিপ্ট তৈরি করেছেন, এমনকি একটি অভিধানও তৈরি করছেন। কিন্তু সমস্যা হলো—প্রবীণরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে ভাষাটিও হারিয়ে যাচ্ছে। অভিবাসন ও আশ্রয়ের অনিশ্চয়তা, বাসস্থানের সংকট—সব মিলিয়ে এই নতুন ‘গ্রাম’গুলো বেশিদিন টিকবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়।
ব্রুকলিনের সেই এলাকাটি—যেখানে রাশমিনা থাকেন—আজ বিশ্বজুড়ের বহু জাতিগোষ্ঠীর এক মিলনমেলা। কেউ এখানে নিজস্ব সংঘ তৈরি করছে, কেউ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কেউ বা রেস্টুরেন্ট বা ছোট ব্যবসা। এখানকার অটো-গ্যারেজ, মসজিদ, হেয়ার সেলুন বা ‘ডলার ভ্যান’গুলোর ভেতর আপনি শুনতে পাবেন আফ্রিকান, এশিয়ান, ইউরোপিয়ান ও লাতিন আমেরিকান ভাষার মিশ্র ধ্বনি। পাশেই ঘানার গির্জায় টুই ভাষা, আজারবাইজানিদের জুহুরি, উজবেকদের আড্ডা—সবই একই শহরের ভেতর।
এই বর্ণময় বাস্তবতা যেন আধুনিক যুগের এক বাস্তব ‘বাবেল টাওয়ার’। এটি কোনো কল্পকাহিনী নয়। এটি এখনকার বাস্তব, যা বাঁচিয়ে রাখা জরুরি—না হলে হারিয়ে যাবে মানুষের ইতিহাসের এক অনন্য সম্পদ। এখনই সময় সেটিকে উপলব্ধি করার, সম্মান করার এবং রক্ষা করার।
আপনার মতামত জানানঃ