সাজিদা ইসলাম পারুল : রাজধানী ঢাকার উত্তর গোড়ানে গত ৬ অক্টোবর ৫৫ বছর বয়সী সজল মোল্লা প্রতিবেশী দুই শিশুকে ধর্ষণ করে। পরদিন কৌশলে আরও দুই শিশুকে ধর্ষণ করে সে। ৬ থেকে ৯ বছর বয়সী এই শিশুরা তাকে ‘নানা’
বলে সম্বোধন করত। এসব শিশুর বাবা-মা শ্রমজীবী হওয়ায় দিনে তাদের অনুপস্থিতির সুযোগে নিজ ঘরে ডেকে নিয়ে এই শিশুদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায় সজল। ঘটনা জানাজানি হলে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
তাদের মতোই অক্টোবর মাসে দেশে ১০১ শিশু ধর্ষণসহ নানা রকম নির্যাতনের শিকার হয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, করোনাকালের সুযোগে প্রশাসনের অবহেলা বেড়েছে। রয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। ফলে পারিবারিক সহিংসতার পাশাপাশি শিশু নির্যাতনের চিত্রও উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তা ছাড়া ধর্ষণ কিংবা শিশুর প্রতি সহিংসতার অনেক ঘটনা আছে, যা প্রকাশই হয় না। লোকলজ্জার ভয়ে ভিকটিম ও তার পরিবারের লোকজন ঘটনা ধামাচাপা দেন। ফলে প্রকৃত শিশু নির্যাতনের চিত্র প্রকাশিত হচ্ছে না।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জানায়, গত মাসে মোট ৪৩৬ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে ৪৪ জন সংঘবদ্ধ ধর্ষণসহ মোট ২১৬ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ সময় ১০১ জন শিশু ধর্ষণ এবং ২৫ শিশু সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ছাড়া ১৬ জন শিশুসহ ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ২৩ জনকে। শ্নীলতাহানির শিকার হয়েছে ৫ জন। তার মধ্যে শিশু ৩ জন। ১২ শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। অ্যাসিড দগ্ধের শিকার হয়েছে ৪ শিশু এবং অ্যাসিড হামলায় মারা গেছে ১ জন।
অক্টোবরে উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছে ১০ জন। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে মোট ১২টি। এর মধ্যে শিশু ৮ জন। পাচারের শিকার হয়েছে ৪ জন (শিশু ১ জন) এবং পতিতালয়ে ৩ জনকে বিক্রি করা হয়েছে। বিভিন্ন কারণে ১১ জন শিশুসহ ৪৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া ৬ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।
যৌতুকের কারণে নির্যাতিত হয়েছে ৮ জন। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৫ শিশুসহ ২১ জন। বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে ৫ জন শিশুসহ আত্মহত্যা করেছে ৬ জন এবং ৮ শিশুসহ ৪৬ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে ৬টি। সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছে ৪ শিশুসহ ৮ জন।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, সারাদেশে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ৪৪৫ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। গত বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শিশুর প্রতি সহিংসতা হয়েছে এক হাজার ৯৯৬টি।
শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, গত ৫ বছরে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রথম ছয় মাসে শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা এবং শিশুদের ওপর অন্যান্য যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। এ বছর জুলাই পর্যন্ত প্রথম সাত মাসে ৫৭২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে অন্তত ২৩ জনকে। এতে বলা হয়েছে, ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে ৮৪ শিশুর ওপর এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৭৫ শিশু।
মহিলা পরিষদ কেন্দ্র্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম সমকালকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তেমন তৎপর নয়। ফলে দিন দিন নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। এমনকি করোনাকালেও ‘গৃহবন্দি’ শিশুরা নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করলেই অপরাধ কমবে বলে তিনি মতপ্রকাশ করেন।
মানবাধিকার কর্মী ও স্ট্রেংদেনিং ফ্যামিলি প্লানিং সার্ভিস থ্রু অ্যাডভোকেসি ইনিশিয়েটিভের ফোকাল পারসন মনজুন নাহার বলেন, শিশুরাও নানা ধরনের বীভৎস ও ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এর অন্যতম কারণ। তাই শিশু ও নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ধর্ষকদের শাস্তি পাওয়াটা জরুরি।
সূত্র : সমকাল
আপনার মতামত জানানঃ