সম্প্রতি ইসরায়েলি সেনাদের বর্বরতা অতিতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ফিলিস্তিনি শিশুদের গুলি করে হত্যা, গ্রেফতার ও নির্যাতনের বহু অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে ইসরায়েলি সেনাদের বিরুদ্ধে।
ফিলিস্তিনের প্রাচীন শহর হেবরনে একটি দোকানে থাকা নিরপরাধ এক শিশুর চোখে গুলি করে তাকে অন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েলি সেনারা। খবর মিডলইস্ট।
এটা ইজ্জ আল-দিন নাদাল বাতাশ নামে ১৪ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি শিশুটির জন্য আর পাঁচটা শুক্রবারের মতোই ছিল। নামাজ, বাড়ির কাজ শেষ করে হেরবনের একটি দোকানে যায়। যেখানে সে চাচাতো ভাই করিমের সাথে কাজ করে।
ইজ্জ আল-দিন বলেন, অন্যান্য শুক্রবারের মতোই নামাজের পর সংঘর্ষ শুরু হয়। ইসরায়েলি সেনারা ফিলিস্তিনি যুবকদের লক্ষ্য করে টিয়ার গ্যাস, শব্দবোমা, রাবার বুলেট ছোঁড়ে। আমরা দোকান থেকে দেখছিলাম। কিছু শিশুও ছিল সেখানে। হঠাৎ করে আমি টের পাই আমার মুখে কিছু আঘাত করেছে। আমি পড়ে যাই। আমার ডান চোখের চারপাশ জুড়ে তীব্র ব্যথা হতে থাকে। সবকিছু ঝাপসা হয়ে যায়।
এরপর সঙ্গে সঙ্গে তাকে হেবরনের একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা জেরুজালেমে বড় কোন হাসপাতালে নিয়ে ভর্তির পরামর্শ দেন।
মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে জেরুজালেম চক্ষু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ফিলিস্তিনি এ শিশুটি এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেলেও আর কখনো চোখে কিছু দেখতে পারবে না।
ইজ্জ আল-দিন নাদাল বাতাশার বাবা আবদুল করিম আল-বাতাশ বলেন, ইসরায়েলের একদল সেনা হেবরনে টহল দেয়ার সময় শিশুদের আটক করতে চাইলে তারা পাথর নিক্ষেপ করে পালিয়ে যায়। ইসরায়েলি সেনারা তাদের উপর হামলা চালায়। সংঘর্ষের মধ্যে ছিল না আমার ছেলে। দোকান থেকে দেখছিল।
অথচ উত্তেজিত বর্বর ইসরায়েলি সেনারা আদালুসিয়া মার্কেটের ওই দোকানটিতে গত শুক্রবার কেনাকাটা করতে যাওয়া তার ছেলের চোখে গুলি করে।
তিনি বলেন, আমার ছেলে ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে কোনও অরকার সংঘর্ষে জড়ায়নি। সে তার চাচাতো ভাইকে নিয়ে দোকানে কেনাকাটার জন্য এসেছিল। এটা অমানবিক। যে কারও জন্য এই ধরনের ক্ষত সারাজীবন বয়ে বেড়ানো অসম্ভব। বিশেষ করে ১৪ বছরের একটা শিশুর জন্য।
আট বছরের শিশুর চোখে গুলি!
এর আগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে চোখ হারায় ফিলিস্তিনি আর এক শিশু।
আট বছরের ফিলিস্তিনি শিশু মালিক ইসাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল দখলদার রাষ্ট্রটির এক পুলিশ সদস্য। এতে শিশুটির বাম চোখে মারাত্মক আঘাত লাগে। পরে চিকিৎসকরা মালিক ইসার বাম চোখটি সরিয়ে ফেলেন। ফিলিস্তিনি রাজধানী অধিকৃত জেরুজালেমের আল-ইসাওয়াইয়া শহরে মর্মান্তিক এ ঘটনাটি ঘটেছিল।
তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম আনাদলু আরবির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, শিশুটির ডান চোখের অবস্থাও আশঙ্কাজনক ছিল। মস্তিষ্কে সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সেটাও অপসারন করা লাগবে বলে জানায় চিকিৎসকরা। তবে মালিক ইসার পিতা চিকিৎসককে অনুরোধ করেন যেভাবেই হোক অন্তত যেন অক্ষত রাখা যায়। কিন্তু তার এই অনুরোধ চিকিৎসক রাখতে পারবেন না বলে তিনি আশঙ্কা করন।
হামলার সময় মালিকের সঙ্গে তার অন্যান্য বোনেরাও ছিল। অল্পের জন্য তারা রক্ষা পেয়েছে ঠিকই, তবে তাদের সবাই মারাত্মক মানসিক আক্রান্তের শিকার হয়েছে। তাদেরও চিকিৎসা প্রয়োজন। আসলে এই হামলা আমাদের পুরো পরিবারকে মানসিকভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।
ইসরায়েলি সেনাদের বর্বরতা
গত কয়েক দশক ধরে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনী নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আসছে। গত বছর ইসরায়েলি সেনারা হত্যা করেছে অন্তত ২৭ ফিলিস্তিনিকে, এদের মধ্যে সাতজনই ছিল শিশু। সম্প্রতি এ তথ্য জানিয়েছে বি’স্লেম নামে একটি ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা।
বি’স্লেমের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ২০২০ সালে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে একজন গাজা উপত্যকায়, ২৩ জন পশ্চিম তীরে (পূর্ব জেরুজালেমসহ) এবং তিনজন প্রাণ হারিয়েছেন ইসরায়েলের মধ্যে।
দখলকৃত পশ্চিম তীরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে ১৬টির তদন্ত করেছে বি’স্লেম। তারা জানিয়েছে, এসব ঘটনায় ফিলিস্তিনিদের যখন হত্যা করা হয়, তখন অন্তত ১১জনই ইসরায়েলি বাহিনী বা অন্য কারও জন্য কোনও ধরনের বিপদের কারণ ছিলেন না। অর্থাৎ একেবারে নিরস্ত্র নিরপরাধ মানুষদেরই হত্যা করেছে ইসরায়েলি সেনারা।
ইসরায়েলি বর্বরতার উদারহরণস্বরূপ ইয়াদ হালাক নামে এক ফিলিস্তিনি যুবকের ঘটনা উল্লেখ করেছে বি’স্লেম। ৩২ বছর বয়সী এ যুবক ছিলেন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, পড়াশোনা করতেন পূর্ব জেরুজালেমের একটি প্রতিবন্ধী স্কুলে। ঘটনার দিন ইসরায়েলি সেনারা ইয়াদের কাছে অস্ত্র রয়েছে সন্দেহ করে থামতে বললে তিনি ভয় পেয়ে ছুটতে শুরু করেন। পরে একটি ডাস্টবিনের পেছনে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। স্কুল থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরত্বে পড়েছিল ইয়াদের প্রাণহীন দেহ।
শুধু নিরীহ মানুষ হত্যাই নয়, গত বছর করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যে অন্তত ৭২৯টি ফিলিস্তিনি স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরায়েলিরা। এর মধ্যে ঘরবাড়ি রয়েছে ২৭৩টি, যার ফলে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এক হাজারেরও বেশি মানুষ।
এছাড়া আরও ৪৫৬টি অনাবাসিক স্থাপনা ও অবকাঠামো ধ্বংস করেছে ইসরায়েলিরা। এর মধ্যে রয়েছে জলাশয়, পাইপলাইন, বৈদ্যুতিক স্থাপনা প্রভৃতি। গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০২০ সালেই ফিলিস্তিনের সবচেয়ে বেশি স্থাপনা ধ্বংস করেছে ইসরায়েল।
সংস্থাটির তথ্যমতে, সেনাবাহিনীর পাশাপাশি পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালাচ্ছে অবৈধ ইসরায়েলি দখলদাররাও। গত বছর এধরনের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২৪৮টি। এক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি তাদের বিভিন্ন মালামাল ও শস্য ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৫২
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ