সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন থানায় হামলার প্রেক্ষিতে হামলাসহ যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঠেকাতে সিলেট জেলা ও মহানগরের সব থানায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ ও জেলার সব থানায় লাইট মেশিনগান (এলএমজি) পোস্ট বসানো হয়েছে। সেই সঙ্গে ঝুঁকি বিবেচনায় প্রতিটি থানায় ৩০ থেকে ৫০ জন সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। তবে পুলিশের এভাবে জায়গায় জায়গায় মেশিন গান তাক করে বসে থাকার ঘটনায় এলাকাগুলোতে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
জানা যায়, সিলেটের ১৭টি থানাসহ পুলিশ ফাঁড়ি ও পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রগুলোতে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। নগরের ছয়টি থানা, চারটি ফাঁড়িসহ প্রতিটি পুলিশ স্থাপনায় বাঙ্কার তৈরি করে সেখানে বসানো হয়েছে অত্যাধুনিক অটোমেটিক লাইট মেশিনগান (এলএমজি) পোস্ট। পাশাপাশি জেলার ১১টি থানায় এই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি বসানোর কাজ চলছে। একই সঙ্গে, ঝুঁকি বিবেচনায় প্রতিটি থানায় অতিরিক্ত ৩০ থেকে ৫০ জন পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এসব চৌকিতে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ।
চরমান পরিস্থিতিতে যে কোনো ধরনের অনাকাঙিক্ষত ঘটনা এড়াতে পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনায় এমন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন থানা, উপজেলা পরিষদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করা গেছে। সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে। ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদ নষ্ট করা হয়েছে। এই অবস্থায় সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) আওতাধীন ছয় থানা, সবকটি ফাঁড়ি ও গুরুত্বপূর্ণ সকল স্থাপনায় বিশেষ নিরাপত্তা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিটি স্থাপনায় বালু ও মাটি দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে বাঙ্কার। সেই বাঙ্কারে এলএমজি পোস্ট বসিয়ে পুলিশ সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্বও পালন করছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী গত বুধবার রাত থেকে সিলেটে পুলিশি স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। বৃহস্পতিবার বিকেলে সরজমিনে কোতোয়ালি মডেল থানায় গিয়ে বস্তা দিয়ে বাঙ্কার বানিয়ে তাতে লাইট মেশিনগান (এলএমজি) নিয়ে পুলিশকে সতর্ক অবস্থানে থাকতে দেখা গেছে। থানার সামনে সব ধরনের সুরক্ষা সামগ্রী পরিহিত অবস্থায় পুলিশের একাধিক পেট্রোল টিমকে প্রস্তুত থাকতে দেখা যায়। নিরাপত্তা জোরদারের কথা নিশ্চিত করেছেন মহানগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপ-কমিশনার বিএম আশরাফ উল্ল্যাহ তাহের। তিনি জানান, যেকোন ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।
তিনি বলেন, “কয়েক দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে উগ্রবাদী গোষ্ঠী নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পদ নষ্ট করেছে। এই অবস্থায় সিলেট মহানগর পুলিশের আওতাধীন ছয় থানা, সব ফাঁড়ি ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বিশেষ নিরাপত্তা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিটি স্থাপনায় বালু ও মাটি দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে এলএমজি (লাইট মেশিনগান) পোস্ট।”
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে গত ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব চালায় হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকরা। পরে হরতাল ডেকে নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় নাশকতা চালায় তারা।
তাহের বলেন, “উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করতে সব থানা, ফাঁড়ি ও স্থাপনায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে বাড়তি পুলিশ।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত বুধবার সিলেট জেলা পুলিশ লাইনসে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি ও পুলিশ সুপারের উপস্থিতিতে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) নিয়ে একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে জেলার সব থানায় বাড়তি নিরাপত্তার অংশ হিসেবে এলএমজি চৌকি স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া থানাগুলোতে পুলিশ লাইনসের অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র সরবরাহ ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
নগর পুলিশ সূত্র জানায়, হেফাজতে ইসলামের হরতালসহ নানা ইস্যুতে পুলিশি স্থাপনায় হামলার ঘটনা ঘটছে। ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে রয়্যাল রিসোর্টে হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হক অবরুদ্ধ হওয়ার ঘটনার পর রাতে সিলেটের সুনামগঞ্জের ছাতক থানায় হামলার ঘটনা ঘটে। গোয়েন্দা তথ্যে এ রকম সহিংসতা সিলেটে আরও ঘটার শঙ্কা থেকে বাড়তি নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে।
জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) লৎফুর রহমান বিশেষ এই নিরাপত্তাব্যবস্থা অভ্যন্তরীণ বলে মন্তব্য করেন। তিনি জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, জেলা পুলিশের অধীন সব থানায় একটি করে নিরাপত্তাচৌকি প্রস্তুত করা হয়েছে এবং সেখানে পালাক্রমে সার্বক্ষণিক একজন করে পুলিশ কর্তব্যরত থাকার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত বুধবার দুপুর থেকে সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে।
মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ জানান, নগরীর সব থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশি স্থাপনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রতিটি স্থাপনায় এলএমজি পোস্ট বসানো হয়েছে। ইতোমধ্যে সব স্থাপনায় পোস্ট বসানোর কাজ শেষ হয়েছে।
তিনি জানান, শুধু থানা বা ফাঁড়ি নয়; সরকারি সব স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাড়তি ফোর্স তৈরি রাখা হয়েছে। কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করলে কঠোরভাবে তা দমন করা হবে।
এদিকে সিলেট জেলার প্রবেশপথসহ আঞ্চলিক সড়কের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পুলিশের পক্ষ থেকে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। এসব চেকপোস্টে পুলিশি নজরদারির পাশাপাশি গোয়েন্দা তৎপরতাও বাড়ানো হয়েছে। জেলা পুলিশের আওতাধীন সব থানায় মেশিনগান পোস্ট বসানোর কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন সিলেটের পুলিশ সুপার মো. ফরিদ উদ্দিন।
তিনি জানান, সব থানায় এলএমজি সরবরাহ করা হয়েছে। ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনায় প্রতিটি থানায় অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। কোনো দুষ্কৃতকারী হামলা চালানোর চেষ্টা করে পার পাবে না। এজন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে হাটহাজারি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ কয়েকটি জায়গায় থানাসহ সরকারি স্থাপনায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকে কেন্দ্র করে হেফাজত ইসলামসহ ধর্মভিত্তিক কিছু দলের বিরোধিতার জের ধরে সহিংসতার সময় সরকারি নানা স্থাপনায় হামলার ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়া করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ঘোষিত লকডাউন কার্যকর করা নিয়েও নানা জায়গায় সংঘর্ষ হয়েছে এবং এর মধ্যে ফরিদপুরের সালথায় সরকারি অফিসে হামলা হয়েছে।
মূলত এসব নানা ঘটনার পর পুলিশ প্রশাসনে নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার খবর স্থানীয় গণমাধ্যমে আসছিলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক ঢিলে কি দুই পাখি মারার চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। করোনা সংক্রমণ রোধে দেশজুড়ে লকডাউনের ঘোষণায় মাটি চাপা পড়লো হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন। তবে করোনা মহামারিতে এই ঢিলেঢালা লকডাউনে হুমকির মুখে পড়ছে সাধারণ মানুষের জীবন। এই অপরিকল্পিত লকডাউন করোনা সংক্রমণের হার কমাতে নিশ্চিতভাবে কোনও প্রভাব ফেলতে পারছে না। তবে হেফাজতে ইসলামের পরিকল্পনায় থাকা বিক্ষোভ কর্মসূচিতে যে পানি ঢেলে দিয়েছে, এব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। একই সাথে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও নিয়ন্ত্রণে নিজেকে সামলে নেয়ার সুযোগ পেল সরকার। তবে যেকোনো মুহূর্তে পরিস্থিতিতে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থেকে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, করোনার মহামারিকে ইস্যু করে সরকার নিজেদের নিরাপত্তা বাড়িয়ে নিল, এ কথাও স্পষ্ট করেই বলা যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১২
আপনার মতামত জানানঃ