শুক্রবার বাংলাদেশের প্রথম সারির গণমাধ্যম প্রথম আলো অনলাইনে একজন পাঠকের মন্তব্য দিয়েই লেখাটি শুরু করি। তিনি লিখেছেন, ‘মানুষ নিরাপত্তাহীন ও আতঙ্কিত বোধ করছে। কেউ কথা বলে না। কারণ, তারা এই “হিংস্র জনতার” মুখোমুখি হতে ভয় পায়। সাংবাদিকেরা চুপ হয়ে গেছে, এমনকি নিজেদের রক্ষা করতেও ভয় পেয়েছে। সবাই নিরাপদে থাকার জায়গা খুঁজছে। ভাবছি, লেখক-সাংবাদিকদের কী হয়েছে? কোথায় মানবাধিকার সংগঠন ও কর্মীরা? তারা সবাই নিশ্চুপ থাকে।’
প্রথমেই পরিষ্কার করে নিই পাঠক যাদের ‘হিংস্র জনতা’ বলছেন, তারা আসলে জনতা নয়, সংঘবদ্ধ অপরাধী। আইনের প্রতি অনুগত মানুষ একত্র হলে আমরা তাদের জনতা বলি। কিন্তু গুজব ছড়িয়ে যখন কিছু ব্যক্তি পরিকল্পিতভাবে অপরাধ সংঘটিত করে, ব্যক্তি বা স্থাপনায় হামলা করে, তখন তারা জনতা থাকে না, অপরাধী হয়।
যেকোনো সমাজ বা রাষ্ট্র টিকে থাকে কতগুলো মৌলিক নীতি ও আদর্শের ওপর। সেখানে কেউ কারও ওপর হস্তক্ষেপ করবে না, একজন অপরজনের ওপর মত চাপিয়ে দেবে না। দিলে সরকার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। যদি সরকার ব্যর্থ হয়, নৈরাজ্য তৈরি হয়। মানুষ আতঙ্কিত বোধ করে। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসে দেশে মব ভায়োলেন্সে অন্তত ১১৪টি ঘটনায় ১১৯ জন নিহত ও ৭৪ জন আহত হয়েছেন। আইনের শাসন থাকলে এটি হওয়ার কথা নয়।
আওয়ামী লীগের আমলে যখন মব ভায়োলেন্স বা আইনশৃঙ্লা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে কথা উঠত, তখন ক্ষমতাসীনেরা পাত্তা দিতেন না। বলতেন, ‘সাংবাদিকদের চোখ খারাপ’ বলে ভালো কিছু দেখতে পায় না। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও কেউ কেউ এ রকম দোহাই দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁরা বলেন, গত ১৫ বছর নিশ্চুপ ছিলেন কেন? এটাও নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার কৌশল। চেয়ারের মানুষ বদলায়, চরিত্র বদলায় না।
সাম্প্রতিক কালের কয়েকটি উদাহরণ দিলেই মব ভায়োলেন্স কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটা বোঝা যাবে। গত সপ্তাহে গুলশানে ৮৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে প্রচুর অবৈধ অস্ত্র, কোটি কোটি টাকা ও আওয়ামী লীগের দোসররা পালিয়ে আছেন বলে গুজব ছড়িয়ে মধ্যরাতে দুর্বৃত্তরা অভিযান চালাল; এর আগে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ডাকাত পড়েছে বলে দুই ব্যক্তিকে হত্যা করা হলো; লালমাটিয়ায় ধূমপানকে কেন্দ্র করে বাগ্বিতণ্ডায় দুই নারীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হলো। কিন্তু এসব ঘটনায় সরকারকে তেমন উদ্বিগ্ন হতে দেখি না।
অপারেশন ডেভিল হান্টে গ্রেপ্তারের সংখ্যা ১০ সহস্রাধিক। এরপরও অপরাধীরা কেন বেপরোয়া, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। মব ভায়োলেন্সের ক্ষেত্রে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিও পরিষ্কার নয়। আইনের ভাষায় যারা অপরাধ করবে, তারাই ডেভিল। কিন্তু সরকার কোনো কোনো ডেভিলকে ধরেছে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখেও না দেখার ভান করছে। বিভিন্ন স্থানে যারা আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে, যারা অন্যের বাড়ি দোকান–অফিস, বাস টার্মিনাল, লঞ্চ ঘাট ইত্যাদি দখল করে আছে, তাদের বিরুদ্ধে জোরালো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
বিধি মোতাবেক সেটিরও ব্যবস্থা নেওয়া যেত। তা নিশ্চিত করাই তো স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব, আপসরফা করা তো তাঁর কাজ নয়।
আবার আসি পাঠক বন্ধুর শেষ মন্তব্যে। যে সমাজে সাংবাদিকেরা নিশ্চুপ থাকেন, মানবাধিকারকর্মীরা অন্যায়কে মুখ বুজে মেনে নেন, সে সমাজে মব সংস্কৃতিই জোরালো হয়। কেবল সাধারণ মানুষ নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এর সংস্কৃতির শিকার হন। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, গত ছয় মাসে পুলিশের ওপর ২২৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থানা এলাকার আউটার রিং রোডে এক পুলিশ সদস্যের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যাতে দেখা যায়, হামলা করে এসআই ইউসুফ আলীর পোশাক ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। অসহায় অবস্থায় অঝোরে কাঁদছেন তিনি। গত সোমবার তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘যখন পুলিশের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে, তখন আর আবেগ ধরে রাখতে পারিনি, কেঁদে ফেলেছি।’
যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মব থেকে রেহাই পান না, তখন সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে, কার কাছে প্রতিকার চাইবে?
আপনার মতামত জানানঃ