রংপুরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) আওতাধীন কাজে ঘুষ দাবি ও সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দেওয়ার অভিযোগে দুই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। অভিযুক্তরা হলেন এলজিইডি রংপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী আখতার হোসেন এবং সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির চেয়ারম্যান কাওছার আলম। তাদের বিরুদ্ধে দুদক আইনে চার্জশিট জমা হয়েছে। আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলেও তাদের আবেদন মঞ্জুর হয়নি। এ অবস্থায় জেল হাজতেও থাকতে হয় তাদের। তবু কর্তৃপক্ষ এখনও তাদের সাময়িক বরখাস্তও করেনি। আদালতের চার্জশিট গ্রহণ ও জেল হাজতে থাকার পরেও তাদের স্বপদে বহাল থাকার বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন দুদকের আইনজীবীরা। এর মাধ্যমে এলজিইডি কতৃপক্ষ আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে আইন বিরোধী কাজ করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
মামলা ও আদালত সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর, রংপুর এর (এলজিইডি) আওতায় ৪ কোটি ২৬ লাখ ও ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে দুটি প্যাকেজে মোট ৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকার কাজের দরপত্র আহবান করা হয়। বিধি মোতাবেক ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ও ওই বছরের ৪ মার্চ দরপত্র জমা দেন নগরীর নিউ ইঞ্জিনিয়ারপাড়ার মৃত আশরাফ উদ্দিন আহম্মেদের ছেলে ঠিকাদার রবিউল আলম বুলবুল।
কিন্তু দরপত্র দু’টি গ্রহণ ও অনুমোদন করার পরেও নোটিফিকেশন অফ অ্যাওয়ার্ড (এনওএ) না দিয়ে রবিউল আলম বুলবুলের কাছে মোট কাজের (৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা) দুই শতাংশ হারে ঘুষ দাবি করেন উল্লেখিত দুই প্রকৌশলী।
এ অবস্থায় ঠিকাদার রবিউল আলম বুলবুল দুই শতাংশ টাকা না দেয়ায় তাকে নিষ্ক্রীয় হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয় এবং সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েও তাকে কাজ না দিয়ে অন্য একজনকে কাজ দেয়া হয়। এ ঘটনায় রবিউল আলম বুলবুল বাদি হয়ে সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে (দুদক) এলজিইডি রংপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী আখতার হোসেন এবং সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির চেয়ারম্যান কাওছার আলমকে আসামি করে ২০১৯ সালের ৭ মে মামলা দায়ের করেন।
তদন্ত শেষে দুদুকের সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
উল্লেখিত দুই আসামি উচ্চ আদালতে থকে চার সপ্তাহের জামিনে ছিলেন। ১০ ফেব্রুয়ারি জামিনের মেয়াদ শেষ হলে রংপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবদেন জানান তারা। শুনানি শেষে বিচারক তাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এলজিইডি সূত্রে জানা যায়, ঘুষের মামলায় রংপুরে কর্মরত নির্বাহী প্রকৌশলী আখতার হোসেন ও সহকারী প্রকৌশলী কাওছার আলমের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত শেষে আদালতে গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর চার্জশিট দাখিল করে। তবে আদালতে হাজির না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়না জারির আদেশ দেন আদালত। এরপর গত ১০ ফেরুয়ারি দুই আসামি আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। তবে রংপুর জেলা ও দায়রা জজ ও বিশেষ জজ মো. শাহেনুর তাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
এ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়। এর পরেও এলজিইডির প্রধান কার্যালয় তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। এরপর দীর্ঘ ২৭ দিন জেল হাজতে থাকার পর হাইকোর্টের নির্দেশে তারা জামিন পান। গত বৃহস্পতিবার ওই দুই প্রকৌশলীসহ পাঁচ আসামি জেলা জজ আদালতে হাজির হন। আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে দুদকের দেওয়া চার্জশিট গ্রহণ করে মামলাটি বিচারের জন্য বিশেষ জজ আদালতে পাঠানোর আদেশ দেন।
এ বিষয়ে রংপুর দুদক আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট শিরিন বলেন, কোনও সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎসহ ফৌজদারী মামলা দায়ের হলে এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির সঙ্গে সঙ্গে তাদের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করতে হবে। আলোচ্য মামলায় এলজিইডির দুই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছে দুদক এবং আদালত সেই চার্জশিট গ্রহণ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাদের চাকরিতে থাকার আইনত কোনও সুযোগ নেই, তাদের অবশ্যই সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতে হবে। তা না হলে আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অবজ্ঞা প্রদর্শন বলে বিবেচিত হবে।
একই কথা বলেন দুদকের অপর আইনজীবী হারুনর রশীদ। তিনি বলেন, এলজিইডির দুই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছেন আদালত। তার ওপর কারাগারে আটক থাকলেই চাকরি থেকে সাসপেন্ড হওয়ার কথা। কিন্তু কীভাবে তারা চাকরিতে বহাল আছেন সেটাই প্রশ্ন।
রংপুর আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট আব্দুল মালেক জানান, দুই প্রকৌশলী দুদকের মামলায় কারাগারে ছিলেন অনেক দিন। আইন অনুযায়ী তাদের সেই সময়েই সাসপেন্ড করার কথা। তারপরেও তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট আদালতে দাখিল হয়েছে ও আদালত তা গ্রহণ করেছে। এ অবস্থায় তাদের আর চাকরিতে থাকার কোনও সুযোগ নেই।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল এই দুই প্রকৌশলীর ক্ষেত্রেই নয়, দেশের সমস্ত সেক্টরেই নিজ সুবিধামতো ঠিকাদারদের কাজ দেওয়ার নামে কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার নামে নির্দিষ্ট পরিমাণ পার্সেন্টিজ এখন রেওয়াজে দাঁড়িয়ে গেছে। এই দুই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে বিধায় বিষয়টি সামনে এসেছে। নয়তো এমন বিষয় রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে।
তবে ঘুষ দাবির মামলার আসামি হয়েও স্বপদে বহাল থাকাতে বিষ্মিত দেশের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ মহলও। তারা বলছেন, ঘুষের কেলেঙ্কারি থাকা আসামিদের কেবল সাময়িক নয়, উক্ত চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দেওয়া উচিত। অথচ দেশের অনিয়মটাই এতো নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে যে, ঘুষ দাবি করা লোকদের নিকট বিষয়টা যেমন স্বাভাবিক তেমনি স্বাভাবিক মনে হচ্ছে আইনের নিকটেও।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৫৬
আপনার মতামত জানানঃ