আগনিয়ান কাসাভাব : এ অব্দি করোনাভাইরাস মহামারীতে সারা বিশ্বে ২.৪ মিলিয়নের অধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পাশাপাশি মুখ থুবড়ে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। করোনাভাইরাসের ভয়াবহ তান্ডবের মাঝেই ভ্যাকসিন মানুষের মনে রুয়ে দিচ্ছিলো এই দুর্ভোগ থেকে বাঁচার আশা। ভাবা হচ্ছিলো, করোনাভাইরাস মানুষের উপর শারিরীক, মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে যে ভোগান্তি এনেছিলো, ভ্যাকসিন হবে তা থেকে মুক্তির উপায়।
কিন্তু যখন ভ্যাকসিন প্রায় মানুষের দ্বারপ্রান্তে, তখন কিছু পূর্ব অনুমিত এবং কিছু নতুন উদ্ভুদ্ধ পরিস্থিতিতে যে আলো মানুষ দেখছিলো, তা অনেকটাই মৃয়মান হয়ে গেছে। প্রথম সারির মেডিকেল জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেট’ জানিয়েছে, ‘যদি সঠিক সময়ের মধ্যে মানুষের হাতের নাগালে ভ্যাকসিন উপলব্ধ না হয়, তবে তার ফল আশাপ্রদ হবে না’।
বেশকিছু ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমতি পাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই ভ্যাকসিন নিয়ে তোড়জোড় হঠাৎই স্তিমিত হয়ে পড়ে। পাশাপাশি বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় হাতেগোনা কয়েকটি ধনতান্ত্রিক দেশই এই গ্রীষ্মের শেষে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করতে পারবে বলে আশা করা যাচ্ছে, যা সামগ্রিক অবস্থার প্রেক্ষিতে একেবারেই অপ্রতুল। ইতোমধ্যে ভাইরাসের মিউটেশন প্রশ্নবিদ্ধ করছে বিদ্যমান ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে।
কেউ কেউ বর্তমান ভ্যাকসিন পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছে বিভিন্ন দেশের সরকারের অনমনীয় আমলাতান্ত্রিকতা এবং ভ্যাকসিন বিরোধী সেন্টিমেন্টকে। এদিকে এই প্রায় প্রতিবন্ধী অর্থনীতিকে ক্রমাগত প্রভাবিত করে চলেছে তিনটি আইডিওলজিক্যাল মিথ। যেগুলো হলো—
- প্রাইভেট সেকটর ইনোভেশনের জন্য সবথেকে যোগ্য।
- অনিয়ন্ত্রিত বাজারই চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে সক্ষম।
- পুঁজিবাদী এই বিশ্বায়ন সবার জন্য সমান সুবিধাজনক।
এই মহামারীতে টীকাদান কর্মসূচিকে উল্লেখিত মিথগুলো আমাদের চোখের সামনে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
প্রথম মিথ: প্রাইভেট সেকটর ইনোভেশনের জন্য সবথেকে যোগ্য
গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের মূল মিথগুলোর একটি হলো, প্রাইভেট সেকশন নতুনত্ব এবং উন্নয়নের একমাত্র কার্যকরী উৎস। কিন্তু জায়েন্ট ফার্মাগুলোকে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, এটা প্রকৃতপক্ষে প্রচারিত এক ডাহা মিথ্যা।
কয়েক দশক ধরেই, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাকসিনকে অপর্যাপ্ত মুনাফার জন্য কম গুরুত্ব দিয়ে আসছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাস সংক্রমণের সময়, ২০১৪ এর মহামারীর আগ অব্দি ভ্যাকসিন আনার কোন প্রচেষ্টাই লক্ষ্য করা যায়নি। করোনাভাইরাস মহামারীর পূর্বে বায়োএনটেকের মতো প্রতিষ্ঠানও ভাইরাস গবেষণার থেকে ওষুধে এমআরএনএ প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে অধিক কাজ করেছে।
প্রকৃতপক্ষে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের এতো দ্রুত আনার পেছনে কাজ করেছে বিভিন্ন দেশের সরকারের অর্থনৈতিক সাপোর্ট এবং ট্যাক্সপেয়ারদের অর্থে করা চুক্তি। একাই যুক্তরাষ্ট সরকার মডার্নার ভ্যাকসিন প্রস্তুত এবং তার ডোজেস কেনার জন্য একাই ২.৫ বিলিয়ন অর্থসাহায্য দিয়েছে। কার্যত ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো নতুন পণ্যের ক্ষেত্রে কম ব্যথে উৎপাদন এবং ঝুঁকিহীন বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করতে চায়।
এছাড়া, ন্যূনতম দুটি রাষ্ট্র মালিকানাধীন কোম্পানি, রাশিয়ার গামেলিয়া ইন্সটিটিউট এবং চীনের সিনোফার্ম সফলভাবেই কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। যা কিনা ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানিগুলো ইনোভেশনের জন্য সবথেকে যোগ্য, এই দাবি নাকোচ করে দেয়।
এসবকিছু বিদ্যমান ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কিংবা গবেষকদের পরিশ্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য নয়। বরং ভ্যাকসিন কার্যক্রমকে ব্যক্তিমালিকানাধীন করা শুধুমাত্র ব্যয়বহুল এবং শোষণমূলক নয়, বরং এটি অদক্ষতাই। কারণ এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা চাইলেই তাদের গবেষণা শেয়ার করতে পারবে না ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে।
দ্বিতীয় মিথ: অনিয়ন্ত্রিত বাজারই চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে অধিক কার্যকর
অন্য একটি ক্যাপিটালিস্ট মিথ হলো প্রতিযোগিতামূলক এবং অনিয়ন্ত্রিত বাজার চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে বেশি কার্যকর এবং একই সাথে পণ্যের সন্তোষজনক বিতরণও সম্ভব। ২০২০ সালের শুরুর দিকে আমরা এই রূপকথার অন্ধকার দিক দেখতে পেয়েছিলাম, যখন রাষ্ট্রগুলো একে অন্যকে পাল্লা দিয়ে চিকিৎসা সরঞ্জামাদি যেমন পিপিই এবং ভেন্টিলেটর সংগ্রহ করেছিলো। আর ভুক্তভোগী ছিলো নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো।
সারাবিশ্বেই চাহিদা ছিল কিন্তু যোগান ছিল কেবলমাত্র ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর হাতে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে এবারও। ভ্যাকসিনের সাপ্লাইয়ে নিয়মতান্ত্রিকতার অভাবে ধনতান্ত্রিক দেশগুলো প্রয়োজনের অধিক ডোজ তাদের নাগরিকদের জন্য নিশ্চিত করে রাখতে চেষ্টা করছে।
ইসরায়েল উচ্চমূল্য প্রদান করায়, সেখানে ভ্যাকসিন প্রদানের হার খুবই বেশি। যুক্তরাষ্ট্রও একই পথ অনুসরণ করছে। এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নেও ভ্যাকসিনের সুষম বন্টন অনিয়ন্ত্রিত। জার্মানিও প্রয়োজনের অধিক ভ্যাকসিন ডোজেস নিজেদের জন্য নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে।
যদি বর্তমান অবস্থা চলতে থাকে, যেখানে অর্থের বিনিময়ে চাহিদামতো ভ্যাকসিন দেশগুলো সংগ্রহ করতে পারবে, এমনকি সংগ্রহের মাত্রা তাদের প্রয়োজনের অধিক হলেও, তাহলে বিশ্বব্যপী চাহিদার সাথে যোগানের সামঞ্জস্য রাখা সম্ভব হবে না। দ্য ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশান এই পরিস্থিতিকে বলছে, ‘ভ্যাকসিন ন্যাশনালিজম’।
তৃতীয় মিথ: পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন সবার জন্য সমান সুবিধাজনক
ক্যাপিটালিজমের তৃতীয় মিথ হলো, বিশ্বায়ন সবার জন্য সমান সুবিধাজনক। কিন্তু ভ্যাকসিন বিতরণ কার্যক্রম লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় এটা কতটা সত্য।
যেখানে পশ্চিমা দেশগুলো ইতিমধ্যেই জনগণের জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করছে, সেখানে বিশ্বের অন্য প্রান্তে এখনও ভ্যাকসিন ক্যাম্পেইন শুরু করাই সম্ভব হয়নি। এমনকি উন্নয়নশীল অনেক দেশকেই, যাদের ভ্যাকসিনের টেস্টিং গ্রাউন্ড হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেখানেও সীমিত সাপ্লাইয়ের কারণে কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন বিতরণ নিয়ে যে অসম নীতি চলছে, এ জন্য আমরা শুধুমাত্র হু-এর ডিরেক্টর জেনারেল টেড্রস অ্যাডানম গেব্রিয়েসাসের বলা ‘দুর্যোগকালীন নৈতিক ব্যর্থতা’-এর মধ্য দিয়েই যাচ্ছি না, এর পাশাপাশি অনিবার্য বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়েও যেতে হচ্ছে। অর্থনীতিবিদেরা ইতিমধ্যে সতর্ক করেছেন, ভ্যাকসিনের সুষম বন্টন সম্ভব না হলে, ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্য তা বেশি ব্যয়বহুল হবে।
যদি এই অসমতা বিদ্যমান থাকে, তাহলে ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর ভ্যাকসিন কার্যক্রম অনর্থক প্রতিপন্ন হবে। এমনকি যদি কিছু দেশ হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করেও নেয়, তবুও মহামারীর কারণে ভ্রমণ এবং গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন বিঘ্নিত হবে।
এক গবেষণায় জানা গেছে, সমগ্র বিশ্বে পক্ষপাতহীন ভ্যাকসিন ক্যাম্পেইন সম্ভব না হয়, তাহলে উন্নত দেশগুলো ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪.৫ ট্রিলিয়ন ডলার।
বিপর্যস্ত পুঁজিবাদ জন্ম দেয় নতুন বিপর্যয়ের
কানাডিয়ান লেখক নাউমি ক্লেইন বিপর্যস্ত পুঁজিবাদকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে দেখিয়েছেন। এই লুন্ঠনমূলক পুঁজিবাদ প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগ থেকে মুনাফা অর্জন করে। বর্তমান মহামারী আমাদের এই বিষয়টিকে আরও কাছ থাকে দেখার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
বৈশ্বিকভাবে নির্ভরশীল একটি অর্থনীতি যা নির্ভর করে আছে শ্রমিক এবং বেশ জটিল সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার উপর। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ যদি ভ্যাকসিন কার্যক্রমের বাইরে থাকে তাহলে ভাইরাস মিউটেশনের যথেষ্ট সুযোগ থেকে যায়। এর ফলে মহামারী আবার নতুন করে শুরু হতে পারে। ভ্যাকসিনের উন্নয়ন কার্যক্রমে চলতে থাকলেও, ভ্যাকসিন প্রদানে অযথা বিলম্ব এবং অসম ব্যবস্থা, কোভিড-১৯ কে একধাপ এগিয়ে রাখবে সবসময়।
এই অবস্থা কয়েক বিলিয়ন সাধারণ মানুষের ভবিষ্যতের জন্য মোটের স্বস্তির নয়। যাদের জীবন ইতোমধ্যেই ভাইরাসের কারণে বিপর্যস্ত। তবে এই ব্যবস্থা ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্য বেশ সুবিধাজনকই প্রতিপন্ন হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি আমরা এই মহামারী থামাতে চাই, মানুষের জীবন বাঁচাতে চাই এবং একই সাথে যদি চাই অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে, খুব দ্রুতই আমাদের এই ক্ষতিকর পুঁজিবাদের কূটকৌশল প্রতিহত করতে হবে এবং একই সাথে নিশ্চিত করতে হবে ভ্যাকসিনের সুষম বন্টন।
লেখক: আগনিয়ান কাসাভাব. প্রফেসর অব ফিলোসফি, সোফিয়া ইউনিভার্সিটি
অনুবাদ : শুভ্র সরকার
আপনার মতামত জানানঃ