বাংলাদেশে ভূমি অফিসকে বলা হয় দুর্নীতিগ্রস্ত খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম। বলা হয়ে থাকে, মাছের রাজা ইলিশ আর দুর্নীতির রাজা ভূমি অফিস। ভূমি অফিস সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম ধারণা রয়েছে তারা এ অভিধার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন বলে মনে হয় না। জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি এতটাই সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে যে, এটিকে মানুষ দেখে অভিশাপ হিসেবে। ভূমি অফিসের দুর্নীতি রুখতে সরকার ও দুদক বহু পরিকল্পনা করেও এর বৃদ্ধি কমাতে পারছে না। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানেই ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হন। এবার ঘুষ গ্রহণের সময় দুদকের হাতে ধরা পড়লেন এক ভূমি অফিসার। ভূমি সেবা দেয়ার বিপরীতে সরকার নির্ধারিত ফি বাদ দিয়ে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হাতে ধরা খেয়েছেন রফিকুল ইসলাম নামে এক ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা। আজ মঙ্গলবার (২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বড়বাড়ি ইউনিয়ন ভূমি অফিসে এ ঘটনা ঘটে।
ছদ্মবেশে থাকা দুদক কর্মকর্তাদের সামনে সেবাগ্রহণকারীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছিলেন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। এসময় তাকে আটক করে দুদক। অভিযানে উপ-সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জিন্নাতুল ইসলাম, এআই ওবাইদুর রহমান, প্রধান সহকারী রেজাউল করিম উপস্থিত ছিলেন।
দুদকের কর্মকর্তারা জানান, ২০২০ সালে দুদকের হটলাইন নম্বরে কিছু অভিযোগ করে ওই ইউনিয়নের সেবা গ্রহণকারী কয়েকজন কৃষক। তদন্ত করতে এসে প্রমাণ পায় এবং টাকা লেনদেনের সময় হাতে নাতে আটক করা হয়। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট আমরা প্রয়োজনীয় প্রমাণসহ সবকিছু হস্তান্তর করবো, তিনি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) যোবায়ের হোসেন বলেন, ‘দুদক কর্মকর্তারা অভিযান শেষে ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তাকে আমার জিম্মায় জমা দিয়েছেন। আমরা অপরাধ পর্যালোচনা করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভূমি ব্যাস্থাপনা সম্পর্কে মানুষের পরিস্কার ধারণা নেই। তাই সমস্যাটাও তারা নির্ধারণ করতে পারেন না। ফলে দালালের কাছে যান, কিন্তু সঠিক জায়গায় তারা আসেন না। তাদের না-জানা বিষয়টাকে পুঁজি করে ভূমি অফিসাররা বাড়তি টাকার বিনিময়ে কাজ করেন। এটা এখন নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। তারা জানান, ভূমি অফিসের সেবাপ্রার্থীরা সব সময়ই অসহায়। যে কোনো সাধারণ মানুষ কাজ করতে গেলে দালাল বা উক্ত অফিসের কর্মচারীদের খপ্পরে পড়তে হয়। নিয়মবহির্ভূত টাকা দিতে হয়। এই সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষের সজাগ হওয়া জরুরি।
তারা মনে করেন, সরকার দেশে যে ডিজিটালাইজেশনের সূত্রপাত করেছেন তা ভূমি অফিসগুলোর সর্বত্র বাস্তবায়ন করে হালনাগাদ যাবতীয় তথ্য সন্নিবেশ পূর্বক সংশ্লিষ্ট ইন্টারনেটে সংযোগ করে সর্বসাধারণের সার্চের সুযোগ করে দিলে (যেহেতু প্রত্যেক ইউনিয়ন পরিষদ অফিসেও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ বর্তমান সরকার করে দিয়েছে) নিরীহ ভূমি মালিকগণ তথা সাধারণ জনগণ অহেতুক অর্থদণ্ড এবং ভোগান্তি থেকে নিষ্কৃতি পাবেন।
তারা জানান, প্রশাসন, স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে সবাই জানে ভূমি অফিসে ঘুষ ছাড়া একটা ফাইলের পৃষ্ঠাও নড়ে না। সবাই সব জেনেও নিরব! সবাই সব জেনেও কী করবে, তারা পারলে এর মধ্যে থেকে কমিশন পাচ্ছে! শুধু সাধারণ জনগণের ক্ষতির খাতটা বাড়ছে। এতে তো কারো কোনো মাথা-ব্যথা নেই। শুধু ভূমি অফিস কেন, বাংলাদেশের সব জায়গায় অবৈধ অর্থ ছাড়া কাজ হয় না। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় জনসাধারণ উৎকোচ প্রদানে বাধ্য হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রায় সকল ভূমি অফিসেই জনগণকে হয়রানির শিকার হয়ে কর্মরত কর্মচারীদের ঘুষ দিতে হয়। কাগজপত্র সঠিক হলেও যেমন ঘুষ দিতে হয়, তেমনি কাগজপত্রে কোনো ত্রুটি থাকলেও দিতে হয় ঘুষ। এমন জঘন্য ও বিশ্রী দশার কবলে নিষ্পেষিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সরকারিভাবে এমন অবস্থার প্রশমনে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
তারা মনে করেন, বাংলাদেশে ভূমি অফিসের অনিয়ম নতুন কোনো ঘটনা নয়। এ দেশের সাধারণ মানুষ বরাবরই এদের দৌরাত্ম্যে নাজেহাল। ফলে যে কোনো সাধারণ মানুষ নামজারি করা, হালনাগাদ সার্টিফিকেট, নকল তোলা প্রভৃতি ভূমি সংক্রান্ত কাজ করতে গেলে এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তিদের খপ্পরে পড়ে প্রতিনিয়তই প্রতারিত হচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকতা-কর্মচারীদের জাতীয় স্বার্থে নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার প্রবণতা ত্যাগ করা জরুরি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ২০২০
আপনার মতামত জানানঃ