শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যু একা কোনো বিচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ড নয়, এটি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতার এক গভীর প্রতিচ্ছবি। একটি মৃত্যু কীভাবে মুহূর্তের মধ্যে রাষ্ট্র, সমাজ ও গণমাধ্যমকে অস্থির করে তুলতে পারে—তার নির্মম উদাহরণ হয়ে উঠেছে এই ঘটনা। কিন্তু আরও ভয়াবহ দিকটি হলো, এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ঘটেছে, তার অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ থেকে নয়; বরং সুপরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করার একটি প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
হাদির মৃত্যুর পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে ভাষা, ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, তা সাধারণ শোকের ভাষা ছিল না। সেখানে ক্ষোভকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা, নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে টার্গেট করা, এমনকি প্রতিশোধমূলক সহিংসতার আহ্বানও দেখা গেছে। এই ডিজিটাল উত্তেজনার ঢেউ বাস্তব জগতে নেমে আসে খুব দ্রুত। প্রশ্ন উঠছে—এই উত্তেজনার চালিকাশক্তি কারা, এবং কেন এই মৃত্যু এত দ্রুত একটি রাষ্ট্রীয় সংকটে রূপ নিল?
সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, হামলার লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে। প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের মতো প্রতিষ্ঠান কেবল ভবন বা অফিস নয়—এগুলো বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিসরের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কোনো আন্দোলনের নৈতিক শক্তি তখনই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়, যখন সেই আন্দোলনের নামে কলম, ক্যামেরা ও তথ্যপ্রবাহকে স্তব্ধ করার চেষ্টা হয়। হাদির মৃত্যুর বিচার দাবি করা আর সংবাদমাধ্যমে আগুন দেওয়া—এই দুইয়ের মধ্যে কোনো নৈতিক সংযোগ নেই, কিন্তু একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে এই দুটিকে একসূত্রে গেঁথে ফেলেছে।
এখানেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে ‘সুযোগ নেওয়ার রাজনীতি’। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে, কোনো সংকট, কোনো হত্যাকাণ্ড বা কোনো গণঅসন্তোষকে পুঁজি করে ভিন্ন একটি এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়। এই ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হাদির মৃত্যু হয়ে উঠেছে একটি ট্রিগার—যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অচলাবস্থা তৈরি করা, আসন্ন নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা চলছে।
এই পরিস্থিতিতে সবাইকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে একটি বিষয়ে—ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বলয় অতীতে বহুবার এমন সংকটকে নিজেদের পক্ষে ব্যবহারের কৌশল দেখিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অরাজকতা ও সহিংসতার পরিবেশ তৈরি হলে রাষ্ট্র সাধারণত কঠোর হয়, আর সেই কঠোরতার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হয় ক্ষমতায় থাকা পক্ষ। গণমাধ্যমে হামলা, রাস্তায় বিশৃঙ্খলা, আগুন—এসব দেখিয়ে খুব সহজেই বলা যায়, “দেশ অস্থিতিশীল, কঠোর ব্যবস্থা ছাড়া উপায় নেই।” এই বয়ানই শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক পরিসর সংকুচিত করে।
এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—হাদির আদর্শ ও তার মৃত্যুকে যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা আদৌ কি তার রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? যিনি ভিন্নমত, মুক্ত চিন্তা ও রাষ্ট্রীয় জবাবদিহির কথা বলতেন, তার মৃত্যুর পর সেই ভিন্নমত প্রকাশের জায়গাগুলোকেই পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে—এ এক ভয়াবহ পরিহাস। এতে হাদির স্মৃতি সম্মানিত হয় না; বরং তা বিকৃত হয়।
রাষ্ট্রের ভূমিকাও এখানে প্রশ্নের বাইরে নয়। হামলার আশঙ্কা আগেই জানানো হয়েছিল, তবু নিরাপত্তা জোরদার করা হয়নি—এই ব্যর্থতার দায় এড়ানো যায় না। আবার হামলার পরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিক্রিয়া, গ্রেপ্তার ও বিবৃতি—সবকিছুই প্রশ্ন তৈরি করছে, তারা কি সত্যিকার অপরাধীদের ধরতে আগ্রহী, নাকি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নামে ভিন্ন কণ্ঠস্বরকে দমিয়ে রাখাই মূল লক্ষ্য হয়ে উঠবে?
এই সংকটে সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সংবাদপত্র বন্ধ, তথ্যপ্রবাহ ব্যাহত, আতঙ্কের পরিবেশ—সব মিলিয়ে সমাজ আবার এক অন্ধকার গলির দিকে এগোচ্ছে। ব্যবসা, শিক্ষা, দৈনন্দিন জীবন—সবকিছুই এই অস্থিরতার শিকার। অথচ যারা সহিংসতা ছড়াচ্ছে বা এর নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে, তারা সাধারণ মানুষের এই ক্ষতির দায় নেয় না।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হলো ধৈর্য। বিচার চাইতে হবে, কিন্তু বিচার হতে হবে আইনের মাধ্যমে। প্রতিবাদ হতে হবে, কিন্তু তা হতে হবে নৈতিক ও শান্তিপূর্ণ। কারণ সহিংসতা যত বাড়বে, ততই গণতান্ত্রিক শক্তি দুর্বল হবে, আর ততই ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা শক্তিগুলো আরও বেশি জায়গা পাবে।
হাদির মৃত্যু আমাদের সামনে একটি আয়না তুলে ধরেছে—আমরা কি সত্যিই ন্যায় চাই, নাকি ন্যায়বোধের আড়ালে নিজেদের ক্ষোভ, প্রতিশোধ আর রাজনৈতিক হিসাব মেটাতে চাই? এই প্রশ্নের উত্তরই ঠিক করবে, বাংলাদেশ কোন পথে এগোবে—গণতন্ত্রের দিকে, না আবার ভয় ও দমননীতির চেনা চক্রে ফিরে যাবে।
এই সময় ইতিহাস আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ভুল সিদ্ধান্ত, আবেগতাড়িত সহিংসতা ও অন্ধ প্রতিক্রিয়া ভবিষ্যতে আরও বড় মূল্য আদায় করবে। তাই এখনই সময় সংযমের, বিবেচনার এবং সচেতন থাকার—কারণ সুযোগের অপেক্ষায় অনেকেই আছে, আর সেই সুযোগ একবার তৈরি হয়ে গেলে তা আর সাধারণ মানুষের হাতে থাকে না।
আপনার মতামত জানানঃ