মানুষের সঙ্গে কুকুরের বন্ধুত্ব কত পুরোনো—এ নিয়ে বহুদিন ধরেই গবেষণা চলছে। কিন্তু বেলজিয়ামের জীবাশ্মবিজ্ঞানী মিৎসে গেরমোঁপ্রে যেটি দাবি করেছেন, তা এই ইতিহাসকে পুরোপুরি পাল্টে দিতে পারে। এখন পর্যন্ত ধারণা ছিল, কুকুর গৃহপালিত হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার বছর আগে। কিন্তু গেরমোঁপ্রের মতে, এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ৩৫ হাজার বছর আগে—অর্থাৎ প্রচলিত ধারণার চেয়ে প্রায় ২০ হাজার বছর আগে। তাঁর হাতে থাকা একটি প্রাচীন খুলি এই দাবির মূল সুত্র।
এই গল্পের শুরু ২০০৯ সালে। তখন গেরমোঁপ্রে বেলজিয়ান ইনস্টিটিউট অব ন্যাচারাল সায়েন্সেসে কর্মরত। তিনি গ্রামের এক গুহা থেকে পাওয়া বরফযুগের প্রাণীর হাড় পরীক্ষা করছিলেন। এসব জীবাশ্মের প্রতি আগ্রহ তাঁর ছোটবেলা থেকেই। একসময় একটা মাথার খুলি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বছরের পর বছর ধরে খুলিটিকে বরফযুগের নেকড়ের মাথা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। কিন্তু গেরমোঁপ্রে খেয়াল করলেন, নাক ও মুখের অংশটি নেকড়ের মতো নয়—এটি ছোট, চওড়া, আর দেখতে অনেকটা গৃহপালিত প্রাণীর মতো। এই বৈশিষ্ট্য দেখে তাঁর সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়।
পরবর্তী সময়ে রেডিওকার্বন পরীক্ষায় দেখা গেল, খুলিটির বয়স প্রায় ৩৫ হাজার বছর। এমন বয়সের কোনো নেকড়ের খুলি এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা পাননি যার মুখমণ্ডলে গৃহপালিত বৈশিষ্ট্যের চিহ্ন রয়েছে। গেরমোঁপ্রে তাই মনে করলেন, এটি সাধারণ নেকড়ে নয়—বরং মানুষের খুব কাছাকাছি থাকা কোনো প্রাচীন কুকুরের খুলি। এটি এমন সময়ের চিহ্ন যখন মানুষ প্রথমবারের মতো নেকড়ের শাবককে লালন-পালন করে সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করছিল। তাঁর মতে, মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে শান্ত ও বন্ধুবৎসল নেকড়ে বেছে রেখে অন্যদের সরিয়ে দিত। ধীরে ধীরে নতুন এক প্রজাতি—প্যালিওলিথিক কুকুর—উন্নত হয়ে ওঠে। মানুষ আর কুকুরের সম্পর্ক তখন শিকার, নিরাপত্তা ও সহবাসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠছিল।
তবে গেরমোঁপ্রের এই দাবি প্রকাশের পর থেকে বৈজ্ঞানিক মহলে বড় ধরনের বিতর্ক শুরু হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এটি হয়তো বিরল আকৃতির নেকড়ের খুলি; আবার কেউ মনে করছেন, এটি সত্যিই গৃহপালিত কুকুরের সবচেয়ে পুরোনো নিদর্শন। বিজ্ঞানীরা বিভক্ত হলেও সবাই একমত—এই খুলিটি মানুষ-কুকুর সম্পর্কের ইতিহাসে নতুন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে। কুকুর কীভাবে মানুষের প্রথম সঙ্গী হলো, সেই গল্পটি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
বরফযুগের বেলজিয়াম ছিল বিস্তীর্ণ তৃণভূমি—যেখানে ঘুরে বেড়াত ম্যামথ, রেইনডিয়ার, ঘোড়া, গুহা-সিংহ ও ভালুক। এমন বিপজ্জনক পৃথিবীতে নিজের টিকে থাকার জন্য মানুষকে নির্ভর করতে হতো সহযোগী প্রাণীর ওপর। গেরমোঁপ্রের ধারণা, এই সময়েই কুকুর মানুষের সহচর, রক্ষক ও পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে। শিকার ধরতে, শত্রু তাড়াতে, পথ চিনতে—সব জায়গাতেই কুকুর ছিল মানুষের পাশে।
এই খুলিটি তাই শুধু একটি প্রাণীর হাড় নয়; এটি মানুষের প্রথম বন্ধুত্বের প্রতীক। যখন মানবসভ্যতা বরফে ঢাকা পৃথিবীর কঠিন বাস্তবতায় টিকে থাকার লড়াই করছিল, তখন মানুষ আর কুকুর একে অন্যের ওপর ভরসা করেছিল। হাজার হাজার বছর পরও সেই সম্পর্ক অটুট। আজকের পোষা কুকুরগুলো যে মানুষের প্রতি অবিশ্বাস্যভাবে বিশ্বস্ত—তা হয়তো সেই প্রাচীন দিনেরই উত্তরাধিকার।
মানুষের সঙ্গে কুকুরের বন্ধুত্ব কীভাবে শুরু হয়েছিল—তার উত্তর হয়তো কোনোদিন পুরোপুরি জানা যাবে না। তবে গেরমোঁপ্রের আবিষ্কার দেখিয়ে দেয়, এই সম্পর্ক আমাদের ধারণার চেয়েও বহু, বহু পুরোনো। আর এই একটি খুলি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানবসভ্যতার ইতিহাস শুধু মানুষের গল্প নয়; এটি মানুষের সবচেয়ে প্রাচীন সাথীর গল্পও।
আপনার মতামত জানানঃ