বাংলাদেশে এখন এমন এক সময় চলছে যখন যৌন ও লিঙ্গ বৈচিত্র্য নিয়ে আলোচনা হলেই একদল মানুষ ক্ষেপে উঠছে। বিশেষ করে ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামী মানুষদের প্রতি বিদ্বেষ, অপমান ও সহিংসতা বেড়ে গেছে। অথচ মজার বিষয় হলো— এই ঘৃণার উৎস আসলে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে নয়, বরং পশ্চিমা সমাজ থেকে ধার করা এক ধরণের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কৌশল। পশ্চিমে যেভাবে ট্রান্সফোবিয়া বা ট্রান্সবিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে, ঠিক সেই ছকেই আজ বাংলাদেশে সেই বিদ্বেষ আমদানি করা হচ্ছে।
ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের নিয়ে ভুল ধারণা নতুন কিছু নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া, ধর্মীয় বক্তা, এমনকি কিছু রাজনীতিবিদের কথাবার্তায় বিষয়টি ভয়ঙ্করভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা দাবি করেন, ট্রান্সজেন্ডার পরিচয় নাকি “বাংলাদেশি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে” বা “বিদেশি প্রভাব।” অথচ ইতিহাস বলছে, এই অঞ্চলে লিঙ্গ বৈচিত্র্য বহু পুরনো একটি বাস্তবতা। হিজড়া সম্প্রদায়, নারীকুল বা অন্যরকম লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষ হাজার বছর ধরে এ সমাজে ছিলেন। তারা কখনো আশীর্বাদ দিতেন, কখনো উৎসবে অংশ নিতেন— সমাজের অংশ হিসেবেই। ব্রিটিশ শাসনের আগে তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি নিষেধাজ্ঞা ছিল না।
সমস্যার শুরু হয় উপনিবেশ আমলে। ব্রিটিশরা তাদের আইন দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় “অপরাধপ্রবণ” হিসেবে পুরো সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করে। দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা দিয়ে তারা যৌন বৈচিত্র্যকে অপরাধ বানায়, আর “ক্রিমিনাল ট্রাইবস অ্যাক্ট” দিয়ে হিজড়াদের গ্রেফতার ও নির্যাতনের পথ তৈরি করে। এসব আইন শুধু যৌন আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য নয়, বরং নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে দমন করার হাতিয়ার ছিল। আজকের দক্ষিণ এশিয়ায় যে কুইয়ার বা ট্রান্সবিরোধী মনোভাব দেখা যায়, সেটি মূলত সেই ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারই বহন করছে।
এখন দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমা দেশগুলোর এক অংশ যেভাবে ট্রান্সফোবিক রাজনীতি চালায়, তার অনুকরণ করছে আমাদের সমাজের কিছু অংশ। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে গত দশকে ট্রান্স মানুষদের ওপর আক্রমণ, অপমান ও আইনি বৈষম্য বেড়ে গেছে। যুক্তরাজ্যে ২০১১ সালে যেখানে ৩১৩টি ট্রান্সফোবিক অপরাধ রেকর্ড হয়েছিল, সেখানে ২০২৩ সালে সংখ্যা বেড়ে প্রায় পাঁচ হাজারে পৌঁছেছে। ট্রান্স মানুষদের প্রকাশ্যে লাঞ্ছনা, তাদের নাম বিকৃত করে ডাকা (ডেডনেমিং) বা টয়লেট ব্যবহারের অধিকার নিয়েও সেখানে বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে।
পশ্চিমে যেসব সংগঠন ও রাজনৈতিক দল এই ঘৃণার রাজনীতি চালায়, তাদের পেছনে বিশাল আর্থিক ও ধর্মীয় শক্তি আছে। যেমন, “অ্যালায়েন্স ডিফেন্ডিং ফ্রিডম” (ADF) নামের এক মার্কিন খ্রিস্টান সংগঠন কোটি কোটি ডলার খরচ করে বিশ্বজুড়ে ট্রান্স ও কুইয়ার অধিকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা আফ্রিকার উগান্ডায় অ্যান্টি-এলজিবিটিকিউ আইন পাসে অর্থায়ন করেছে, যুক্তরাজ্যে ট্রান্স অধিকারবিরোধী রাজনীতিবিদদের সহায়তা দিয়েছে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে আদালতে মামলা চালাচ্ছে যাতে ট্রান্স তরুণরা নিজেদের দেহ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে না পারে।
দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশের কিছু ইসলামপন্থী বক্তা বা প্রচারক এখন সেই একই যুক্তি ব্যবহার করছেন, শুধু ধর্মীয় ভাষায়। পশ্চিমে যেভাবে বাইবেল উদ্ধৃত করে ট্রান্সফোবিয়া ছড়ানো হয়, এখানেও কোরআন বা ইসলামিক যুক্তি ব্যবহার করে তা ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এই ধার করা ঘৃণাই আসলে নতুন সাম্রাজ্যবাদ— যেখানে একদল মানুষ অন্যের ধর্মের কথাবার্তা ধার করে নিজেদের সমাজে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। তারা মনে করে তারা ধর্ম রক্ষা করছে, কিন্তু বাস্তবে তারা এক ধরনের পশ্চিমা ঘৃণানীতি বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ট্রান্সফোবিয়া শুধু ট্রান্স মানুষদের জন্যই বিপজ্জনক নয়, বরং এটি প্রান্তিক সকল জনগোষ্ঠীর জন্য হুমকি। যেমন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নারী, আদিবাসী ও দরিদ্র মানুষও নানা রকম বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এই সব কিছুর মধ্যে একটা মিল আছে— সমাজের একটা অংশ “কেউ প্রকৃত বাংলাদেশি নয়” এই ধারণা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা সমাজে বিভাজন তৈরি করছে, যা অতীতে উপনিবেশবাদীরা করেছিল “বিভাজন করে শাসন” নীতিতে।
আজকের বাংলাদেশের ট্রান্সফোবিয়া তাই কেবল কোনো ধর্মীয় বা নৈতিক ইস্যু নয়, বরং এক রাজনৈতিক হাতিয়ার। মানুষকে বিভ্রান্ত করতে, নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে এবং সহজ লক্ষ্য বানাতে ট্রান্স মানুষদের ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেকেই মনে করেন ট্রান্স মানুষরা সমাজের জন্য “ঝুঁকি,” অথচ তারা কেবল নিজেদের পরিচয় অনুযায়ী বাঁচতে চায়। কাজ, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার অধিকার— এগুলো তাদেরও মৌলিক অধিকার। কিন্তু সমাজের একাংশ তাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো লিঙ্গ বৈচিত্র্যকে “অন্য” হিসেবে দেখা হয়নি। ইসলামি সংস্কৃতিতেও এর উদাহরণ আছে— সুফি ঐতিহ্যে আত্মার বৈচিত্র্যকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, দেহ নয়। হিজড়া সম্প্রদায় শত শত বছর ধরে ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে অংশ নিয়েছে। অথচ এখন যে ঘৃণার ভাষা ছড়ানো হচ্ছে, তা আমাদের সংস্কৃতির নয়— তা পশ্চিমের রাজনৈতিক কৌশল থেকে ধার করা।
এমনকি যারা বলে ট্রান্স মানুষরা পশ্চিমা প্রভাব আনছে, তারাই নিজেরা পশ্চিমের ঘৃণা আমদানি করছে। এই মানসিক দাসত্ব সবচেয়ে ভয়ংকর। তারা ভাবছে তারা ধর্ম রক্ষা করছে, কিন্তু বাস্তবে তারা ধর্মকে ব্যবহার করছে অন্যকে দমনের জন্য। তারা ভুলে যাচ্ছে— ইসলাম, মানবতা ও বাংলাদেশের সংস্কৃতি— সবই করুণা, ন্যায় ও সহানুভূতির শিক্ষা দেয়।
অতএব, যদি সত্যিই কেউ পশ্চিমা প্রভাব থেকে দেশকে মুক্ত করতে চায়, তাহলে ট্রান্সফোবিয়া, কুইয়ারফোবিয়া ও বিদ্বেষের রাজনীতি থেকে মুক্ত হওয়াই প্রথম পদক্ষেপ। কারণ এই ঘৃণার শিকড় আমাদের নয়, অন্যের। বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি সবসময়ই ছিল বহু রঙের, বহু পরিচয়ের— যেখানে সবাইকে জায়গা দেওয়া হয়েছে। ট্রান্সজেন্ডার মানুষের অস্তিত্ব, ইতিহাস ও আত্মপ্রকাশ বাংলাদেশের সমাজেরই অংশ, বিদেশি নয়।
আজ যারা ঘৃণা ছড়াচ্ছে, তারা হয়তো ভাবে তারা সমাজ বাঁচাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তারা আমাদের সমাজকে সংকীর্ণ, অমানবিক ও পরনির্ভর করে তুলছে। প্রকৃত স্বাধীনতা তখনই আসবে, যখন আমরা বুঝব— মানবিকতা কোনো পশ্চিমা বা পূর্বের বিষয় নয়; এটি আমাদের সকলের মৌলিক দায়িত্ব। তাই পশ্চিম থেকে ধার করা ঘৃণার বদলে আমাদের উচিত নিজের মানবিক ইতিহাসের দিকে তাকানো, যেখানে প্রত্যেক মানুষ— ট্রান্স হোক বা না হোক— সমান সম্মান ও নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার রাখে।
আপনার মতামত জানানঃ