এক ট্রান্সজেন্ডার পুরুষের হামলার শিকার হওয়া এবং হাসপাতালে ছয়দিন লড়াইয়ের পর মৃত্যুর কাছে হার মানা আবার সেই প্রশ্ন তুলে এনেছে সামনে যে, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা জার্মানিতে কতটা নিরাপদ? তাদের নিরাপদ জীবনযাপন এবং বেঁচে থাকার অধিকার রক্ষা করা কি আদৌ সম্ভব হচ্ছে?
এখানে ট্রান্সফোবিয়া শব্দটাও প্রশ্ন হয়ে ফিরে আসে। ট্রান্সফোবিয়া হল এমন ধারণা ও ঘটনাবলীর সংকলন যা রূপান্তরকামী ব্যক্তিদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব, অনুভূতি বা ক্রিয়াগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে। ট্রান্সফোবিয়ায় সামাজিক লিঙ্গ প্রত্যাশা মেনে চলেন না এমন মানুষদের প্রতি ভয়, বিদ্বেষ, ঘৃণা, হিংস্রতা, ক্রোধ বা অস্বস্তি প্রকাশ করা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে৷ এটি প্রায়শই হোমোফোবিক দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি প্রকাশ করা হয় এবং তাই এটি হোমোফোবিয়ার একটি দিক হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। ট্রান্সফোবিয়া হল অনেকটা বর্ণবাদ এবং লিঙ্গ বৈষম্যের মত এক ধরনের কুসংস্কার এবং বৈষম্যবাদ।
এই যেমন ম্যুন্সটার, আউসবুর্গ এবং ব্রেমেন- জার্মানির এই তিনটি শহর গত তিনমাসে বড় খবর হয়েছে ট্রান্সজেন্ডারদের ওপর নৃশংস হামলার কারণে৷ তিন হামলার একটিতে মালটে সি. গিয়েছিলেন লেসবিয়ান কয়েকজন নারীকে বাঁচাতে৷ নারীদের তিনি একা রক্ষা করতে পারেননি৷
বরং স্টোফার স্ট্রিট ডে-র উৎসবে অংশ নিতে গিয়ে নিজেই গুরুতর আহত হন তৃতীয় লিঙ্গ-বিদ্বেষীদের হামলায়৷ হাসপাতালে নেয়ার পর কোমায় চলে যান তিনি৷ ছয়দিন পর চলে যান পৃথিবী ছেড়েই৷
ঘটনাটি সারা জার্মানিতে আলোড়ন তোলে৷ ক্ষমতাসীন দলগুলোর অনেক নেতাই তীব্র নিন্দা জানান৷ ওলাফ শলৎসের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের অংশীদার মধ্য-বামপন্থি সোশাল ডেমোক্র্যাট (এসপিডি) দলের সাসকিয়া এসকেন টুইটারে লেখেন, ‘‘সমাজে যে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের বিরুদ্ধে হামলা যথারীতি চলছে এ ঘটনা তারই বিভৎস এক নমুনা৷ প্রতি সপ্তাহে, প্রতিদিন ঘটছে এমন ঘটনা৷”
এসপিডি নেত্রী যা লিখেছেন, পরিস্থিতি আসলে তার চেয়েও খারাপ৷ পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিদিন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের বিরুদ্ধে গড়ে কমপক্ষে দুটি হামলা হয় জার্মানিতে৷
জার্মানির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও মনে করে, বাস্তবে এমন হামলা দিনে দুটির চেয়ে বেশিই হয়৷ লেসবিয়ান অ্যান্ড গে অ্যাসোসিয়েশন (এলএসভিডি)-র দাবি, শতকরা ৯০ ভাগ ঘটনাই পুলিশকে জানানো হয় না৷
দেখা গেছে, ক্রিস্টোফার স্ট্রিট ডে-র মতো উৎসবগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে সেখানেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা বেশি অনিরাপদ৷ এলএসভিডি-র কে্ন্দ্র্রীয় কমিটির আলফোনসো পান্তিসানো বলেন, ‘‘ দৃশ্যমান হওয়ার আরেকটা অর্থই যেন বিপদ৷ কারণ, এমন সমাবেশে যোগ দিয়ে ভিন্ন লিঙ্গের এই মানুষেরা নিজেদের ঝুঁকিতেও ফেলেন৷এ বিষয়টি স্বীকারের সততা আমাদের থাকা উচিত৷”
তবে হামলা যে শুধু এ ধরনের উৎসবেই হয়, তা নয়৷ পান্তিসানোর মতে, ‘‘এসব হামলা সপ্তাহের প্রতিদিনই হয়ে থাকে৷ দিনের যে কোনো সময় শহরের ব্যস্ততম রাস্তা থেকে শুরু করে সবচেয়ে সংকীর্ণ গলি পর্যন্ত সব জায়গাতেই হয়ে থাকে৷ সাবওয়েতে, বাসে, স্কুলের মাঠে, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, ক্লাবে, শপিং সেন্টারে- বলতে গেলে সর্বত্রই হয় এ ধরনের হামলা৷ দুর্ভাগ্যজনক এবং একটু বাড়াবাড়ি মনে হলেও এটাই সত্য যে, সত্যিকার অর্থে কখনোই নিরাপদ নই আমরা৷”
নেই সম্পূর্ণ তথ্য
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ওপর হামলার তথ্য জার্মানিতে নিয়মিত সংরক্ষনও করা হয় না৷ ২০২০ সালে সর্বশেষ এ ধরনের হামলার তথ্য প্রকাশ করেছিল কেন্দ্রীয় পুলিশের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় (বিকেএ)৷
সব শহরের পুলিশ বিষয়টিকে সমান গুরুত্বও দেয় না৷ তাই রাজধানী বার্লিনের পুলিশ বরাবরই তৃতীয় লিঙ্গের কোনো মানুষের ওপর হামলার ঘটনাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে নথিবদ্ধ করলেও অন্যান্য শহরগুলোতে এমন ঘটনাকে সাধারণত সাধারণ হামলা হিসেবেই নথিবদ্ধ করা হয়৷
এ প্রসঙ্গে পান্তিসানো বলেন, ‘‘আমি যদি এখন মিউনিখ, স্টুটগার্ট বা ফ্রাঙ্কফুর্টের কোনো থানায় গিয়ে বলি যে, আমি গে বলে আমার ওপর হামলা হয়েছে, পুলিশ তখন সাধারণ এক শারীরিক নিগ্রহ হিসেবে তা নথিবদ্ধ করবে৷”
হামলার সাথে জড়িত কারা?
মাল্টে সি. হত্যার ঘটনায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ওপর হামলাকারীদের নিয়েও আলোচনা এখন তুঙ্গে৷ ম্যুনস্টারের এ ঘটনায় চেচনিয়া থেকে আসা কিছু মানুষ জড়িত ছিলেন৷ জার্মানিতে এমন বড় বড় কিছু হামলায় মুসলিম তরুণ বা অভিবাসনের জন্য জার্মানিতে আসা ব্যক্তিদের জড়িত থাকতে দেখা গেছে৷
সাইকোলজিস্ট এবং ‘ইসলামিজম’ বিষয়ক বইয়ের লেখক আহমাদ মনসুর বিল্ড পত্রিকাকে বলেন, ‘‘সমকামীদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা শুধু চেচেনদের মধ্যেই যে ব্যাপকভাবে রয়েছে তা নয়, আফগানিস্তান এবং সিরিয়া থেকে আগতদের মাঝেও তা রয়েছে৷ এসব দেশ থেকে অনেক মানুষ আসার কারণে জার্মানিতে হোমোফোবিয়া বাড়ছে৷”
তবে অনেক হামলায় জার্মানির উগ্র ডানপন্থিদের সম্পৃক্ততাও লক্ষ্য করা গেছে৷ বিকেএ-র তথ্যেও তার উল্লেখ রয়েছে৷
উদ্বিগ্ন নয় রাজনীতিবিদরা
সম্প্রতি ট্র্যান্সফোবিয়া নিয়ন্ত্রণের খসড়া পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে জার্মানির অ্যাকসেপ্টেন্স অব সেক্সুয়াল অ্যান্ড জেন্ডার ডাইভার্সিটি নামের একটি সংস্তা৷ সরকারি এ সংস্থার কমিশনার সভেন লেমান খসড়া পরিকল্পনাটি ইতিমধ্যে জার্মানির বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাঠিয়েছেন৷
তবে পান্তিসানো তাতে খুব একটা আশাবাদী হতে পারছেন না৷ তার ধারণা, অতীতের মতো এই তৎপরতাও কয়েকদিন পরে আর দেখা যাবে না৷ আসলে এক বছর আগের আরেকটি পদক্ষেপের কথা তার মনে পড়ছে তার৷
২০২১ সালে জার্মানির ১৬টি রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা এক সভায় হোমোফোবিয়া এবং ট্র্র্যান্সফোবিয়া নির্মূল করার জন্য একটা ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷
পান্তিসানো বলেন, ‘‘(এক বছর আগে সিদ্ধান্ত হলেও) তাদের প্রথম সভাটি হবে এই সেপ্টেম্বরে৷ সুতরাং এই এক বছর রাজনীতিবিদরা এই ইস্যুতে ঘুমিয়েছেন৷ আমরা আসলে এমন একটা দেশে বাস করি যে দেশ সবসময় বিভিন্নতাকে সমর্থন করে এমন ভাণ করতে সবসময় পছন্দ করে৷”
এসডব্লিউ/এসএস/১৪২৫
আপনার মতামত জানানঃ