দেশে ট্রান্সজেন্ডার বান্ধব স্বাস্থ্যসেবা না থাকায় স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় এই গোষ্ঠীর মানুষদের। করোনা মহামারি মধ্যে চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি বৈষম্য ও লাঞ্চনার শিকার হয়েছেন ট্রান্সজেন্ডার গোষ্ঠীর সদস্যরা। লাঞ্চনার ভয়ে অনেকে নির্দিষ্ট কিছু সেবাকেন্দ্র ছাড়া অন্য কোথাও সেবা নিতে যাননি বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা। এই পরিস্থিতি উত্তরণে সরকারি-বেসরকারি সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে।
করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে এ গোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা, খাদ্য সংকট, বৈষম্য নিরসনে করণীয় শীর্ষক এক সংলাপে রোববার দুপুরে অংশ নিয়ে এমন অভিযোগ করেন ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য, সেবা ও আইনি অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থার ‘সম্পর্কের নয়া সেতু’ সভাপতি জয়া সিকদার।
সংলাপটি রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তব্য দেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে নারী পক্ষ, সচেতন হিজড়া অধিকার সংঘ, সুস্থ জীবন, পদ্মকুঁড়ি হিজড়া সংঘ, আলোকিত শিশুসহ বেশকিছু সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
সংগঠনের সভাপতি জয়া সিকদার বলেন, ‘করোনাকালীন সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। তারা নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় পড়লেও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। হাসপাতালে গিয়েও চিকিৎসকদের সহযোগিতা পায়নি। হিজড়া রোগীকে পুরুষ সিটে ভর্তি করাবেন, নাকি নারী সিটে ভর্তি করাবেন এ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন।’
‘বঞ্চিত হয়েছে মহামারি মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা। যৌনরোগসহ, শারীরিক নানা সমস্যায় পড়লেও, স্বাস্থ্যসেবা পেতে অনেক জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রতিটি হাসপাতালে নারী ও পুরুষের আলাদা শয্যা থাকলেও এ গোষ্ঠীর চিকিৎসায় আলাদা ব্যবস্থা নেই। যে কারণে সেবা না গিয়ে অনেকেই হাসপাতাল ছেড়েছে। দেশে করোনা আক্রান্ত হয়েছে ১৯ লাখের বেশি মানুষ, তবে এ জনগোষ্ঠীর কতজন আক্রান্ত, সেই তথ্য সরকারের কাছে নেই।’
করোনাকালীন সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। তারা নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় পড়লেও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। হাসপাতালে গিয়েও চিকিৎসকদের সহযোগিতা পায়নি। হিজড়া রোগীকে পুরুষ সিটে ভর্তি করাবেন, নাকি নারী সিটে ভর্তি করাবেন এ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন।’
তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে দীর্ঘদিন লকডাউনে এ গোষ্ঠীর পেশা অনুযায়ী দোকান এবং অন্যান্য পেশাজীবী মানুষদের কাছ থেকে টাকা তোলাও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে চরম খাদ্যাভাব দেখা দেয় এই জনগোষ্ঠীরর মধ্যে।
‘আমরা অনেক অভিয়োগ পেয়েছি লকডাউনের মধ্যে দোকানে খাবার কিনতে গিয়েও লাঞ্চনার শিকার হয়েছে। বলা হয়েছে, তোমাদের কাছে খাবার বিক্রি করা হবে না, তোমরাই করোনা ছাড়াও। তাদের কাছে পায়সা থাকলেও কিনে খেতে পাচ্ছে না। লকডাউনের সময় অর্থ সংকটে ছিল এ গোষ্ঠীর মানুষজন। এমনকি এমন অভিযোগ পেয়েছি, খাবার না পেয়ে এক হিজড়া বিষ চেয়েছিলেন।’
জয়া সিকদার আরও বলেন, ‘করোনা থেকে সুরক্ষা নিশ্চিতের জন্য সরকার গত বছর ৭ ফেব্রুয়ারি টিকাদান কর্মসূচি চালু করে। তবে এ জনগোষ্ঠীর জাতীয় পরিচয় ও জন্মনিবন্ধন জটিলতার কারণে নিবন্ধন করতে না পারায় শুরুর দিকে টিকা নিতে পারিনি। যারা টিকা নিতে গেছেন, তারা লাইনে দাঁড়াতে গিয়ে লাঞ্চনার শিকার হয়েছেন। টিকা না দিয়ে বাড়ি ফিরেছেন অনেকেই।’
সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের শহিদুল জামান বলেন, ‘সব জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব কিন্তু আমরা কতটুকু করতে পাচ্ছি। অন্যান্য দেশের একজন মানুষ যে সুযোগসুবিধা ভোগ করছে, আমাদের দেশে ১ হাজার মানুষ মিলে সেই সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। এই আমাদের দেশের বাস্তব অবস্থা।
‘সরকারের বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে ১৩০টি। এই কর্মসূচির আওতায় প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ রয়েছে। এদের সঠিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে বাজেটের সব অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। তাই সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য সরকারি-বেরসকারি সব সংস্থার এগিয়ে আসতে হবে।’
সম্পর্কের নয়া সেতুর সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম টুটুল বলেন, ‘করোনাকালে হিজড়াদের জীবনে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। তাঁদের সম্পর্কের নয়া সেতুর পক্ষ থেকে খাদ্য সহায়তা, মানসিক সাপোর্ট আমরা দিয়েছি। ভবিষ্যতে এমন মহামারি আসলে আমরা যেন মোকাবিলা করতে পারি, এ জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’
সংযোগ সভায় সমাজসেবা কর্মকর্তা শহীদুজ্জামান বলেন, ‘সরকার সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় হয়তো সব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না।’
সংলাপে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সংলাপে কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন ‘সম্পর্কের নয়া সেতু’র সভাপতি জয়া।
সুপারিশগুলো হলো— এ গোষ্ঠীর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতে হাসপাতালগুলোতে আলাদা শয্যার ব্যবস্থা করা। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে যেন সহায়তা পেতে পারে সে সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দেওয়া এবং বৈষম্যমূলক আচরণ যেন না হয় সেদিকে নজর রাখা।
বৈষম্য দূর করতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা তৈরি করতে হবে এবং যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। এ গোষ্ঠীর লোকেরা যে ধরনের যৌন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য জটিলতার মুখোমুখি হয়, সে সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে সরকারি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলোতে। লকডাউনের ক্ষতিগ্রস্ত এই জনগোষ্ঠীর উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা দিতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২৩৪৮
আপনার মতামত জানানঃ