ভারত, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ঘিরে সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন এক অদ্ভুত জটিলতার জন্ম দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিশেষত জ্বালানি বাজারকে কেন্দ্র করে এই সংঘাত আজ বৈশ্বিক অর্থনীতি, কূটনীতি এবং উন্নয়ন কৌশলকে প্রভাবিত করছে। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার রাজনৈতিক কৌশল এবং কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অংশ হিসেবে ভারতীয় পণ্যের উপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করেছে, অন্যদিকে ভারত নিজের জ্বালানি নিরাপত্তা এবং উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কিনে চলেছে। এই সমীকরণ শুধু ভারত বা রাশিয়ার অর্থনীতিকেই নয়, ন্যাটো দেশগুলোর কৌশলকেও প্রভাবিত করছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, ভারতকে ঘিরে মার্কিন-রুশ নীতির দ্বন্দ্ব এক বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছেন, যা কার্যত ভারতের জন্য এক বড় ধাক্কা। এই শুল্ক আরোপের মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে রাশিয়া থেকে ভারতের অপরিশোধিত তেল আমদানি। মার্কিন প্রশাসনের দৃষ্টিতে, এই পদক্ষেপ ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে যাতে তারা রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানি বাণিজ্য কমায় এবং পশ্চিমা দেশগুলোর রাশিয়াবিরোধী অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটও দাবি করেছেন, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত পরোক্ষভাবে রাশিয়াকে প্রভাবিত করছে এবং এর ফলে ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর চাপ বাড়ছে।
অন্যদিকে, ভারতের অবস্থান অনেকটা ব্যালান্সড বা ভারসাম্যপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। তিনি যেমন রাশিয়ার পাশে থাকার বার্তা দিচ্ছেন, তেমনি ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার কৌশল এবং অবস্থানও জানতে চাইছেন। এটি একদিকে ভারতের ঐতিহ্যবাহী নিরপেক্ষ নীতি বজায় রাখার প্রচেষ্টা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের কূটনৈতিক গুরুত্ব আরও সুসংহত করার কৌশল। মোদির এই অবস্থান নিছক রাজনৈতিক সৌজন্য নয়, বরং ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা, বাণিজ্য ভারসাম্য এবং ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য এক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমাদের দ্বিচারিতার বিষয়টি ভারত বারবার তুলে ধরছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, উন্নয়নকে বিপন্ন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বরং উন্নয়নের মাধ্যমেই বিশ্বশান্তি আসতে পারে। রাশিয়ার কাছ থেকে তেল আমদানি নিয়ে যখন পশ্চিমা দেশগুলো ভারতের সমালোচনা করছে, তখন তারাই আবার অন্য সময়ে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করেছে। এই ভণ্ডামিপূর্ণ আচরণের বিরুদ্ধে ভারত তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। জয়শঙ্কর নিউইয়র্কে জি২০ বৈঠকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, জ্বালানি বাণিজ্যকে অনিশ্চিত করা মানে পুরো বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলা। ফলে ভারতের অবস্থান হলো—সংলাপ এবং কূটনীতির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা, কোনো ধরনের জবরদস্তি বা একতরফা চাপের মাধ্যমে নয়।
ভারতীয় কূটনীতির এই ধারা একেবারেই নতুন নয়। বরং স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত ‘নিরপেক্ষ আন্দোলন’-এর (Non-Aligned Movement) অন্যতম অগ্রণী রাষ্ট্র। সেই ঐতিহ্য আজও বহন করছে। তবে পার্থক্য হলো, আজকের ভারত বিশ্ব অর্থনীতি এবং কূটনীতির এক বড় শক্তি, যাদের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক বাজারকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের, বিশেষত প্রতিরক্ষা এবং জ্বালানি খাতে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কও একইসঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রযুক্তি, বাণিজ্য এবং কৌশলগত দিক থেকে ওয়াশিংটনের সহযোগিতা ভারতের জন্য অপরিহার্য। এই দুই শক্তিধর রাষ্ট্রের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করাই ভারতের বড় চ্যালেঞ্জ।
ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্যও এই সংঘাতকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, ন্যাটো দেশগুলোর উচিত চীনের উপরও ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করা। অর্থাৎ, ট্রাম্প কেবল রাশিয়ার ওপর নয়, চীনের বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান নিতে চাইছেন। এতে স্পষ্ট যে, মার্কিন প্রশাসন বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু এর প্রভাব পড়ছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর, বিশেষ করে ভারত এবং অন্য এশীয় দেশগুলোতে।
ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তার প্রশ্নটি এখানে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ ভারত, যেখানে দ্রুত শিল্পায়ন, নগরায়ন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে। এই উন্নয়নের জন্য বিপুল পরিমাণ জ্বালানির প্রয়োজন। রাশিয়ার কাছ থেকে তেল আমদানি ভারতকে তুলনামূলক সস্তায় জ্বালানি পেতে সহায়তা করছে। ফলে এই সম্পর্ক হঠাৎ ছিন্ন করা ভারতের জন্য সহজ নয়। মার্কিন শুল্ক চাপ, রাজনৈতিক চাপ বা ন্যাটোর কূটনৈতিক তৎপরতা ভারতের এই বাস্তব প্রয়োজনকে উপেক্ষা করতে পারবে না।
অন্যদিকে, রাশিয়ার জন্যও ভারত একটি কৌশলগত অংশীদার। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার বাজার অনেক সংকুচিত হয়েছে। এই অবস্থায় ভারত এবং চীনের মতো দেশগুলো রাশিয়ার জন্য বড় ভরসা। তাই পুতিন মোদির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন এবং ভারতের সমর্থন ধরে রাখতে চাইছেন। মোদি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেন সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে বারবার মত প্রকাশ করেছেন। এটি ভারতের ‘কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন’-এর প্রমাণ, যেখানে তারা সরাসরি কারও পক্ষ না নিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে।
সর্বশেষ ঘটনাগুলো প্রমাণ করছে, ভারত এখন আর কোনো বৈশ্বিক শক্তির ‘অনুসারী রাষ্ট্র’ নয়। বরং নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে তারা স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। মার্কিন শুল্ক আরোপ একদিকে ভারতের অর্থনীতির জন্য ধাক্কা হলেও, অন্যদিকে এটি ভারতকে আরও দৃঢ় করেছে যে তারা নিজেদের জ্বালানি নীতি এবং উন্নয়ন কৌশল নিয়ে আপস করবে না। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখাই ভারতের মূল কূটনৈতিক কৌশল।
অবশেষে বলা যায়, এই সমীকরণ শুধু তিন দেশের সম্পর্ক নয়, বরং বৈশ্বিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভারত আজ এমন এক অবস্থানে পৌঁছেছে, যেখানে তারা শুধু ভোক্তা বা অংশীদার নয়, বরং বৈশ্বিক কূটনীতির চালক শক্তি। মার্কিন শুল্ক আরোপ, রাশিয়ার সঙ্গে তেল বাণিজ্য, ন্যাটোর কৌশল এবং ভারতের উন্নয়নকেন্দ্রিক নীতি—সবকিছু মিলে আজকের বিশ্বে ভারতের ভূমিকাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। আর এই ভূমিকাই ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোকে নির্ধারণ করবে।
আপনার মতামত জানানঃ