ডেঙ্গু এখন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলোর একটি। প্রতি বছর বর্ষাকাল ও বর্ষা-পরবর্তী সময়ে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। তবে চলতি বছর বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে একটি বিষয়—ডেঙ্গুতে মৃতদের অর্ধেকের বেশি মানুষই ত্রিশ বছরের নিচের বয়সী। বিষয়টি যেমন চিকিৎসকদের উদ্বিগ্ন করেছে, তেমনি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছেও এটি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ এই বয়সী মানুষদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সাধারণত শক্তিশালী থাকে। অথচ এদের মৃত্যু হচ্ছে দ্রুত, অনেক সময় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দুই-এক দিনের মধ্যেই।
ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে গেলেই চোখে পড়ে সারি সারি বিছানায় শুয়ে থাকা তরুণ রোগীদের। অনেকের হাতে স্যালাইন চলছে, কারো পরিবারের সদস্য শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে আছেন। তারা সবাই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। রোগীরা বলছেন, প্রথম দিকে জ্বরকে সাধারণ জ্বর ভেবে অবহেলা করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে প্রচণ্ড ব্যথা, শরীর দুর্বল হয়ে পড়া এবং বারবার বাথরুমে যেতে হওয়ায় বাধ্য হয়ে হাসপাতালে আসতে হয়েছে। অনেকে আবার দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসায় অবস্থা জটিল হয়ে পড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৮৭ জন। এর মধ্যে ৯৪ জনের বয়স ত্রিশের নিচে। আক্রান্ত হয়েছেন ৪৩ হাজারেরও বেশি মানুষ। আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঢাকা ও বরিশাল বিভাগে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২১ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণরাই সবসময়ই ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন। কারণ এই বয়সীরা চাকরি, ব্যবসা বা অন্যান্য কাজে প্রতিদিন বাইরে বের হন, যানবাহন ব্যবহার করেন, বাজার-ঘাটে যান, অনেক সময় নির্মাণস্থলে কাজ করেন। এ সব জায়গায় মশার কামড়ে তারা বেশি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনায় থাকেন।
তবে শুধু আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি হওয়াই নয়, মৃত্যুহারও এবার চোখে পড়ার মতো। চিকিৎসকরা মনে করছেন, এর প্রধান কারণ দেরিতে চিকিৎসা নেওয়া। সাধারণত শিশু বা বয়স্কদের ক্ষেত্রে পরিবার দ্রুতই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু তরুণরা অনেক সময় নিজেদের শক্তিশালী ভেবে জ্বরকে গুরুত্ব দেন না। ফলে কয়েকদিন জ্বর-ব্যথায় ভোগার পর যখন হাসপাতালে আসেন, তখন অনেক সময় তারা ‘শক সিনড্রোমে’ আক্রান্ত হয়ে পড়েন। এই পর্যায়ে এসে চিকিৎসকদের হাতে রোগীকে বাঁচানোর জন্য সময় থাকে খুবই সীমিত।
‘শক সিনড্রোম’ ডেঙ্গুর মারাত্মক জটিলতা। এতে রোগীর রক্তচাপ দ্রুত কমে যায়, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পর্যাপ্ত রক্ত না পেয়ে অকেজো হতে শুরু করে। রোগী দ্রুত অচেতন হয়ে যেতে পারেন এবং মৃত্যুঝুঁকি অত্যন্ত বেড়ে যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু ডেথ রিভিউ কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছর এখন পর্যন্ত ৫৬ জন রোগী শক সিনড্রোমে মারা গেছেন। এছাড়া জটিল উপসর্গে মৃত্যু হয়েছে ৩৬ জনের, হেমোরেজিক সিনড্রোমে নয় জনের, অঙ্গ বিকলজনিত জটিলতায় পাঁচ জনের এবং হৃদযন্ত্রের শকে ছয় জনের। অর্থাৎ তরুণ বয়সী রোগীরা দেরিতে হাসপাতালে আসার কারণে দ্রুত শকে চলে যাচ্ছেন এবং তাদের মৃত্যু ঘটছে।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর থেকে অন্তত প্রথম তিনদিন রোগীর অবস্থা খুব ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। কারণ এই সময়ের পর থেকেই রোগীর শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে যেতে শুরু করে। বারবার বমি হওয়া, তীব্র পেট ব্যথা, শরীর থেকে রক্ত পড়া বা অস্বাভাবিক প্রস্রাব হওয়া—এসব উপসর্গ দেখা দিলেই অবিলম্বে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। দেরি করলে রোগীকে শক বা রক্তক্ষরণের ঝুঁকি থেকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে।
ঢাকার আলমনগর হাউজিং এলাকার বাসিন্দা রাজিয়া বেগম, যিনি বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, জানান তার চোখে রক্ত জমে গেছে, শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা, হাতে ফোসকা পড়ে গেছে। তিনি হেমোরেজিক সিনড্রোমে আক্রান্ত। এমন জটিলতায় পড়া রোগীর সংখ্যা এবার কম নয়। চিকিৎসকরা বলছেন, অনেক সময় অবহেলা বা দেরি করার কারণে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মধ্যে এই জটিলতা দেখা দেয়, যা জীবননাশী হতে পারে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলছেন, যেসব রোগী মারা যাচ্ছেন তাদের অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছেন। অর্থাৎ তারা যখন হাসপাতালে এসেছেন, তখন তাদের অবস্থা এতটাই জটিল ছিল যে চিকিৎসা দেওয়ার পর্যাপ্ত সময় মেলেনি। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে থেকে যারা রাজধানীর হাসপাতালে আসেন, তাদের ক্ষেত্রে দেরি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ফলে তারা চিকিৎসকদের হাতে পৌঁছানোর আগেই শকে চলে যাচ্ছেন।
তরুণদের মৃত্যু বৃদ্ধির আরেকটি কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাদের সচেতনতার অভাব। এই বয়সের মানুষরা সাধারণত মনে করেন শরীর শক্তিশালী, সহজে কিছু হবে না। তারা দীর্ঘ সময় ধরে অফিস বা কাজ করে, ভিড়ের মধ্যে থাকে, আর ডেঙ্গুর ঝুঁকি সম্পর্কে অবহেলা করে। অথচ মশা প্রতিরোধে সহজ ব্যবস্থা নেওয়া—মশারি ব্যবহার, ফুলদানি বা খালি ড্রামে জমে থাকা পানি ফেলে দেওয়া, বাজার বা অফিসে পুরো হাত-পা ঢাকা পোশাক পরা—এসব তাদের জন্য জীবনরক্ষাকারী হতে পারতো।
চিকিৎসকরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর ‘ওয়ার্নিং সাইন’ এর জন্য অপেক্ষা করা যাবে না। কেবল জ্বর হলেই রক্ত পরীক্ষা করতে হবে, আর ডেঙ্গু পজিটিভ হলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। অবহেলা করলে জটিলতা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। তারা আরও বলছেন, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি হয়। তাই এই সময়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।
বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ নতুন নয়। গত এক দশক ধরে এই রোগ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। রাজধানী ঢাকার ঘনবসতি, পানি নিষ্কাশনের দুর্বল ব্যবস্থা, অগোছালো নগরায়ণ—সব মিলিয়ে মশার প্রজনন ক্ষেত্র বিস্তৃত হচ্ছে। এডিস মশা দিনের বেলায় কামড়ায় এবং সাধারণত ঘরের ভেতরেই জন্ম নেয়। তাই বাসার ভেতরে ও আশপাশ পরিষ্কার রাখা, জমে থাকা পানি দূর করা এবং নিয়মিত স্প্রে বা অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া অপরিহার্য।
তরুণ বয়সীদের মৃত্যু এভাবে বাড়তে থাকলে সেটি শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থা নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বড় প্রভাব ফেলবে। কারণ এই বয়সীরাই দেশের শ্রমশক্তি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রধান চালিকাশক্তি। তাদের মৃত্যু মানে উৎপাদনশীলতার ক্ষতি, পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া। তাই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থা নয়, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা এবং নগর পরিকল্পনাও সমান জরুরি।
এখন প্রয়োজন বহুমুখী পদক্ষেপ। প্রথমত, তরুণদের সচেতন করতে হবে যে ডেঙ্গু অবহেলা করার মতো রোগ নয়। দ্বিতীয়ত, চিকিৎসা গ্রহণে দেরি না করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তৃতীয়ত, নগর কর্তৃপক্ষকে মশকনিধন কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। চতুর্থত, সমাজের প্রতিটি পরিবারকে নিজেদের আশপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে। এবং সর্বশেষে, সরকারকে পর্যাপ্ত বেড, স্যালাইন ও ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে রোগীরা চিকিৎসা বঞ্চিত না হন।
ডেঙ্গু একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। কিন্তু অবহেলা, দেরি এবং অপ্রস্তুত চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে এ রোগ মৃত্যুর মিছিল বাড়াচ্ছে। ত্রিশের নিচে তরুণরা যে দ্রুত মারা যাচ্ছেন, তা আমাদের সতর্ক সংকেত। এখনই যদি সবাই মিলে প্রতিরোধে মনোযোগী না হই, তাহলে সামনে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ