সুস্বাস্থ্য মানুষ জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। সুস্থ দেহ ও মনের অভাবে মানুষ ব্যক্তিগত, সামাজিক বা ধর্মীয় দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে পারে না। তাই প্রাচীনকাল থেকেই চিকিৎসা মানবজীবনের মৌলিক চাহিদা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। যুগে যুগে মানুষ রোগবালাই থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য নানা চেষ্টা করেছে। কিন্তু সুসংগঠিত হাসপাতাল ব্যবস্থা চিকিৎসাসেবার মান উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
মুসলিম সভ্যতার সময়েই বিশ্ব ইতিহাসে প্রথম সুসংগঠিত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। খ্রিষ্টাব্দ ৭০৭ সালে উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবনু আবদুল মালিক হাসপাতালকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। তিনি চিকিৎসক নিয়োগ দেন, তাদের বেতন নির্ধারণ করেন, কুষ্ঠরোগী ও অন্ধদের জন্য বিশেষ সেবা চালু করেন এবং রোগীদের ভরণপোষণের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করেন। তখন থেকেই মুসলিম সমাজে চিকিৎসাশাস্ত্রের গুরুত্ব বেড়ে যায়। হাসপাতালগুলো শুধু চিকিৎসা কেন্দ্রই ছিল না, শিক্ষার ক্ষেত্র হিসেবেও পরিচিতি পায়।
মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ব্যাপকভাবে উন্নত হয়। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অগণিত হাসপাতাল গড়ে ওঠে। কিছু হাসপাতাল বিশেষায়িত, আবার কিছু ছিল সকল ধরনের রোগের চিকিৎসার জন্য উন্মুক্ত। কারাগারের বন্দিদেরও চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকত। এসব হাসপাতালকে তখন বলা হতো ‘বিমারিস্তান’।
মুসলিম বিশ্বের প্রায় সব শহরে হাসপাতাল স্থাপনের প্রচেষ্টা ছিল। বাগদাদ থেকে শুরু করে মাগরিব-আন্দালুস পর্যন্ত, মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র বিমারিস্তান স্থাপন করা হয়। তখন বিমারিস্তান দুই ধরনের ছিল। প্রথমটি ছিল ভ্রাম্যমাণ বিমানিস্তান। এগুলো অস্থায়ী স্থাপনার মতো হতো। পরিস্থিতি, প্রয়োজন ও রোগপ্রাদুর্ভাব অনুসারে এগুলো এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরানো হতো। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধ, খাদ্য, পানি, পোশাক এবং চিকিৎসক, সহকারী চিকিৎসক ও ওষুধ প্রস্তুতকারী দিয়ে এগুলোকে সাজানো হতো। ভ্রাম্যমাণ বিমানিস্তান অনেকটা আধুনিক যুগের মেডিকেল ক্যাম্পের মতো কাজ করত।
দ্বিতীয়টি ছিল স্থায়ী বিমারিস্তান। এগুলো নির্দিষ্ট শহর বা স্থানে স্থাপিত হতো এবং সেখানে স্থায়ীভাবে চিকিৎসা দেয়া হতো। বড় শহরে এই ধরনের হাসপাতাল আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার অগ্রদূত হিসেবে পরিচিত ছিল। মুসলিম সমাজের প্রায় সব শহরে স্থায়ী বিমারিস্তান গড়ে উঠেছিল। সাধারণত খলিফা, সুলতান, ধনী ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, মানবতার সেবা এবং নিজেদের স্মৃতিকে চিরন্তন করার জন্য এসব হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতেন।
হিজরি ৮৮ সনে (৭০৭ খ্রিষ্টাব্দ) বিশ্বের প্রথম স্থায়ী বিমারিস্তান নির্মাণ করেন উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক। তবে এটি নির্দিষ্ট চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত ছিল। প্রথম সম্পূর্ণ সংগঠিত ও সব ধরনের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল খলিফা হারুনুর রশিদের বাগদাদের ‘বড় বিমারিস্তান’-এ। সেখানে সব ধরনের চিকিৎসা ছিল। হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল খলিফার ব্যক্তিগত চিকিৎসক জিবরাইল ইবনে বাখতিশুকে। এবং অধ্যক্ষ ছিলেন মাসুয়া আল-জাওযি।
বিমারিস্তানগুলো দিনে দিনে আরও উন্নত ও সংগঠিত হতে থাকে। সেখানে আধুনিক হাসপাতালের মতো সব সুবিধা ছিল। এই হাসপাতালগুলো কেবল চিকিৎসাকেন্দ্রই ছিল না, শিক্ষালয় হিসেবেও পরিচিত। সেখানে চিকিৎসাশাস্ত্রের সব শাখায় শিক্ষাদান হতো, গবেষণা হতো এবং নতুন চিকিৎসক গড়ে তোলা হতো।
বড় বড় বিমারিস্তানে সাধারণত দুটি বিভাগ থাকত। একটি পুরুষদের জন্য, অন্যটি নারীদের জন্য। প্রত্যেক বিভাগে রোগ অনুযায়ী আলাদা কক্ষ থাকত—দেহের অভ্যন্তরীণ রোগের জন্য একটি, আহতদের জন্য আলাদা, চক্ষু রোগীদের জন্য আলাদা এবং ভাঙা হাড় জোড়া লাগানোর জন্য ভিন্ন কক্ষ। সংক্রামক রোগী, বিশেষ করে কুষ্ঠ রোগীদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা থাকত। প্রতিটি বিমারিস্তানে ফার্মেসির মতো ওষুধ বিতরণ কক্ষও থাকত, যাকে বলা হতো ‘শরাবখানা’ বা ‘ঔষধালয়’।
বিমারিস্তানে বিভিন্ন ধরনের কর্মচারী থাকত—প্রধান চিকিৎসক, তত্ত্বাবধায়ক, নারী ও পুরুষ পরিচারক প্রমুখ। প্রাথমিক যুগে মুসলিম সমাজে চিকিৎসাশাস্ত্র অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই চর্চা করা হতো। পরবর্তীতে তা ধীরে ধীরে পাঠ গ্রহণ, পর্যবেক্ষণ ও অনুমোদনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট নিয়মের আওতায় আসে। আব্বাসীয় খলিফা আল-মুকতাদির বিল্লাহ চিকিৎসাশাস্ত্রে সনদ প্রদানের ব্যবস্থা করেন। নবীন চিকিৎসককে পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যতার প্রমাণ করতে হতো। এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চিকিৎসাশাস্ত্রকে পেশাগত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করে।
মুসলিম সমাজে চিকিৎসকদের নৈতিকতার কঠোর শপথ গ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল। শপথ করানো হতো—কাউকে বিষ প্রয়োগ করা যাবে না, গর্ভপাত ঘটানোর ওষুধ দেওয়া যাবে না, অবৈধ কাজ করা যাবে না, রোগীর গোপন তথ্য ফাঁস করা যাবে না এবং চিকিৎসা প্রদানের সময় দৃষ্টি সংযত রাখতে হবে।
মুসলিম বিশ্বের বিমারিস্তানগুলো যুদ্ধক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। অনেক ক্রুসেডার সেনাপতি ও সৈনিক গির্জার নিষেধ উপেক্ষা করে শত্রু মুসলিমদের কাছ থেকে চিকিৎসা নিতেন। জার্মান লেখিকা সিগরিদ হুনকে ক্রুসেডে অংশ নেওয়া এক পোলিশ শল্যচিকিৎসকের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তিন বছরে তিনি বহু মুসলিম চিকিৎসকের সঙ্গে পরিচিত হন, তাদের প্রশংসা ও সমালোচনাও করেন। তিনি এমন সামরিক হাসপাতালও দেখেছেন, যা ৩০ থেকে ৪০টি উটে বহন করে যুদ্ধক্ষেত্রে নেওয়া হতো।
হাসপাতাল নির্মাণে কয়েকটি বিষয় খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হতো। খোলামেলা ও সুবিধাজনক স্থান নির্বাচন করা হতো, পানির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা হতো, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করা হতো। আধুনিক আসবাবপত্র ও চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে হাসপাতাল সাজানো হতো। খোলা প্রাঙ্গণ, বাগান, ফলদ এবং সুগন্ধি গাছপালা রাখা হতো, যা রোগীর মনোবল ও সুস্থতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করত।
মুসলিম জাতি সভ্যতার উন্মেষে যা অবদান রেখেছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো বিমারিস্তান। এই হাসপাতালগুলো রোগীর চিকিৎসা, শিক্ষাদান, গবেষণা এবং নৈতিক চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মুসলিম বিশ্বের মেডিকেল ইতিহাসে বিমারিস্তান শুধু চিকিৎসাকেন্দ্র নয়, মানবতা ও জ্ঞানচর্চার এক অনন্য প্রতীক হিসেবে আজও স্মরণীয়।
আপনার মতামত জানানঃ