বাংলাদেশে সম্প্রতি সেনা কর্মকর্তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তা দেশের বিচারব্যবস্থা ও সামরিক কাঠামো উভয়ের জন্যই একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃপক্ষ শেখ হাসিনাসহ মোট ৩০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে, যাদের মধ্যে ২৪ জনই বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একসঙ্গে এত সংখ্যক সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হলো। এতে দেশের বিচারব্যবস্থা, সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ও আইনগত ক্ষমতার সীমারেখা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
আইনজীবী ও বিশ্লেষকদের মতে, ফৌজদারি বা মানবতাবিরোধী অপরাধে সেনা কর্মকর্তাদের বিচার কোন আদালতে হবে, এটি বাংলাদেশের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ নয়, কিন্তু এই পরিমাণে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া নজিরবিহীন। সেনাবাহিনীর নিজস্ব আইন বা মিলিটারি জাস্টিস সিস্টেম অনুযায়ী, পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় কোনো সদস্য অপরাধ করলে তার বিচার সাধারণত সামরিক আদালতে হয়। কিন্তু যদি কোনো সেনা কর্মকর্তা সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধ করেন, তাহলে সেই অপরাধের বিচার প্রচলিত ফৌজদারি আদালতেই করা যায়। অতীতে নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলাই এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ, যেখানে তিনজন সেনা কর্মকর্তা র্যাবের অধীন কাজ করার সময় জড়িত ছিলেন। তাদের প্রথমে সেনা বাহিনী থেকে অবসরে পাঠানো হয়, পরে প্রচলিত ফৌজদারি আইনে বিচার হয়।
বর্তমান ঘটনাটি আলাদা কারণ এটি মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় পড়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনে এই মামলাগুলো চলছে, এবং এই আইন সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীম বলেন, সংবিধান অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইনের মর্যাদা রাখে। তাই যদি অন্য কোনো আইন এই আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তবে সেই আইন কার্যকর থাকবে না। অর্থাৎ, সেনা কর্মকর্তা বা ডিসিপ্লিনারি ফোর্সের সদস্য হলেও, তাদের বিচার ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনেই হতে পারে। আইনটি স্পষ্টভাবে বলেছে যে আর্মি, নেভি, এয়ারফোর্স, পুলিশ, র্যাব কিংবা অন্য কোনো গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও এই আইনের আওতায় আসতে পারেন।
অন্যদিকে, আইনি সংশোধনের দিক থেকেও সাম্প্রতিক ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ। গত ৬ অক্টোবর আইন মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে একটি সংশোধনী জারি করেছে, যেখানে বলা হয়েছে যে, যদি কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা সেনা সদস্যের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গৃহীত হয়, তবে তিনি আর সরকারি পদে থাকতে পারবেন না। অর্থাৎ, কেউ যদি সরকারি চাকরিজীবী অবস্থায় অভিযুক্ত হন, তাহলে তদন্ত চলাকালীন তিনি পদে বহাল থাকতে পারবেন না। এর ফলে বর্তমানে অভিযুক্ত ১৪ জন কর্মরত সেনা কর্মকর্তার চাকরিতে থাকা অনুপযুক্ত হবে, এবং তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা বা অবসরে পাঠানো হতে পারে।
এই ঘটনার পর সেনা সদর দপ্তর বা আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এখনো কোনো মন্তব্য করেনি। তবে অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা বলছেন, এই মামলাগুলোর রায়ের মাধ্যমে সামরিক ও অসামরিক আদালতের এখতিয়ার আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তাদের মতে, সামরিক আইনে তিনটি অপরাধ—হত্যা, ধর্ষণ ও ডাকাতি—সাধারণত ফৌজদারি আদালতেই বিচার করা হয়। তবে সেনাপ্রধান চাইলে বিশেষ পরিস্থিতিতে সামরিক আদালতে বিচার করার ক্ষমতা রাখেন। অর্থাৎ, একই ঘটনার বিচার কখনও কখনও দুই আদালতের মধ্যেই সমন্বিতভাবে হতে পারে, যাকে আইনজীবীরা বলেন ‘কনকারেন্ট জুরিসডিকশন’।
এছাড়া অতীতের অভিজ্ঞতাও দেখায়, অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হলে তা সাধারণ আদালতেই হয়। কারণ, অবসরে গেলে তারা আর সেনা বাহিনীর অধীন থাকেন না। এই প্রক্রিয়া ২০১৪ সালের সাত খুন মামলায় দেখা গেছে। সেক্ষেত্রে বর্তমান মামলাগুলোর অনেক অভিযুক্ত যেহেতু অবসরপ্রাপ্ত, তাদের বিচারও ফৌজদারি আদালতের মতোই হবে, তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনে।
আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা গেলে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনটি বাংলাদেশের সংবিধানের সপ্তম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত। ফলে এই আইন অন্য কোনো আইনের চেয়ে প্রাধান্য পাবে। প্রসিকিউটর তামীমের ভাষায়, এই আইনের অধীনে যে কোনো ডিসিপ্লিনারি ফোর্সের সদস্যের বিচার হতে পারে, এমনকি তারা যদি তখনও কর্মরত থাকেন। তাই কর্মরত সেনা কর্মকর্তাদের বিচার সামরিক আইনে নয়, ট্রাইব্যুনাল আইনে করা হবে, এবং এটি সংবিধান দ্বারা বৈধ ও সুরক্ষিত।
তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই প্রক্রিয়া বাস্তবে জটিল হতে পারে। কারণ, সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা, অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা ও গোপনীয়তা বজায় রাখা জাতীয় নিরাপত্তার অংশ। ফলে ট্রাইব্যুনালে চলমান বিচার সেনা বাহিনীর অভ্যন্তরীণ মানসিকতায় প্রভাব ফেলতে পারে। একই সঙ্গে এটি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পর্যায়েও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। শেখ হাসিনাসহ সাবেক সরকার প্রধান ও প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকায় বিষয়টি কেবল আইনগত নয়, রাজনৈতিক দিক থেকেও গভীর প্রভাব ফেলবে বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল (অব.) ড. নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন, ফৌজদারি অপরাধের বিচার সাধারণ আদালতেই হওয়ার কথা, কিন্তু প্রয়োজনে সামরিক আদালতে নেওয়ার সুযোগ থাকে। তার মতে, বিচারিক প্রক্রিয়ার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত সত্য উদঘাটন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, তা যে আদালতেই হোক না কেন। তবে তিনি স্বীকার করেন যে, একসঙ্গে এত সংখ্যক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা সেনা বাহিনীর ইতিহাসে নজিরবিহীন এবং এটি গোটা প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ও ভবিষ্যৎ কার্যক্রমে প্রভাব ফেলতে পারে।
অন্যদিকে, কিছু আইন বিশেষজ্ঞ বলছেন, এই মামলাগুলো বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার একটি নতুন অধ্যায় তৈরি করবে। কারণ, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুধু ব্যক্তি নয়, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও প্রতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতার দিকটিও সামনে আনে। তাদের মতে, এটি বাংলাদেশের আইন ও ন্যায়বিচারের কাঠামোকে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করবে।
সবশেষে বলা যায়, সেনা কর্মকর্তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুধু একটি আইনি প্রক্রিয়া নয়, এটি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার জন্য একটি পরীক্ষার মঞ্চ। এখানে আইন, সংবিধান, প্রশাসন এবং সামরিক শৃঙ্খলা—সব কিছুর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার সংবিধান দ্বারা সুরক্ষিত হলেও, এর প্রয়োগ যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়, তা নিশ্চিত করাই হবে প্রকৃত চ্যালেঞ্জ। এই বিচার প্রমাণ করবে—বাংলাদেশে ন্যায়বিচার কেবল সাধারণ নাগরিকদের জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্ষমতাধারীরাও আইনের ঊর্ধ্বে নন। এভাবেই আইন, রাষ্ট্র ও বিচারব্যবস্থা মিলেই একটি জবাবদিহিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ।
আপনার মতামত জানানঃ