ইসরায়েল–হামাস যুদ্ধের উত্তেজনাপূর্ণ সময়েও শান্তির আশায় যাত্রা শুরু করেছিল কিছু সাহসী মানুষ। তাদের লক্ষ্য ছিল—গাজার অবরোধ ভাঙা, মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া এবং বিশ্বের কাছে একটাই বার্তা পৌঁছে দেওয়া, যে যুদ্ধ নয়, মানবতার জয় হোক। সেই যাত্রার অংশ ছিলেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। কিন্তু সেই মানবতার অভিযাত্রা এখন বন্দিত্বে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলি সেনারা গাজামুখী ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনের নৌবহরে অভিযান চালিয়ে শহিদুল আলমসহ বহু অধিকারকর্মীকে আটক করে নিয়ে গেছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও মানবাধিকারকর্মীরা। এখন তাঁরা ইসরায়েলের কুখ্যাত কেৎজিয়েত কারাগারে বন্দি।
ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন দীর্ঘদিন ধরে গাজায় ইসরায়েলি অবরোধের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলো বিশ্বাস করে, গাজার সাধারণ মানুষদের পাশে দাঁড়ানো মানবতার দায়িত্ব। গাজায় খাদ্য, ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার জন্যই এই নৌযাত্রা শুরু হয়েছিল। এইবারের বহরে ছিল মোট নয়টি নৌযান, যার মধ্যে আটটি ছিল ‘থাউজেন্ড ম্যাডলিনস টু গাজা’ নামের একটি উদ্যোগের অংশ। এসব নৌযানে উঠেছিলেন মানবিক কর্মী থেকে শুরু করে পার্লামেন্ট সদস্য পর্যন্ত বিভিন্ন পেশার মানুষ। তাঁদের সবার লক্ষ্য ছিল একই—গাজার মানুষ যেন নিঃশ্বাস নিতে পারে, যুদ্ধের আগুনের মধ্যে যেন অন্তত মানবিক সহায়তার পথ খুলে দেওয়া যায়।
কিন্তু ইসরায়েলি সেনারা তাঁদের সেই প্রচেষ্টাকে থামিয়ে দেয়। বুধবার, আন্তর্জাতিক জলসীমার কাছাকাছি অবস্থানে থাকা অবস্থায় ইসরায়েলি বাহিনী হঠাৎ করে নৌবহরে হামলা চালায়। জাহাজগুলো ঘিরে ফেলে সেনারা। এরপর জাহাজে থাকা সব অধিকারকর্মী ও নাবিককে ধরে নিয়ে যায়। পরে তাঁদের আশদোদ বন্দরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং আইনি প্রক্রিয়া শেষে পাঠানো হয় নেগেভ মরুভূমির কেৎজিয়েত কারাগারে। দৃক থেকে জানানো হয়েছে, এই বন্দিশালাটি ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় আটককেন্দ্র, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনি বন্দীদের ওপর নির্যাতন ও অমানবিক আচরণের অভিযোগ রয়েছে।
আদালাহ নামের মানবাধিকার সংগঠন, যারা ইসরায়েলের আরব সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করে, তারা জানিয়েছে যে নৌবহরের অধিকারকর্মীরা ইসরায়েলি সেনাদের হাতে শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। তাঁদের মারধর, অপমান এবং ভয়ভীতি দেখানোর মতো আচরণ করা হয়েছে। এই ঘটনার পর থেকেই আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ইউরোপের কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের এই পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে। কারণ এই অভিযানে ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও আয়ারল্যান্ডের কয়েকজন সংসদ সদস্যও ছিলেন, যাঁদের ইসরায়েল পরে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়েছে।
এদিকে ফ্লোটিলার সংগঠকরা বলছেন, এটি কোনো রাজনৈতিক অভিযান ছিল না, বরং মানবিক সহায়তার একটি প্রচেষ্টা ছিল। থাউজেন্ড ম্যাডলিনস টু গাজা নামের সংগঠনটি তাদের এক বিবৃতিতে বলেছে, ইসরায়েল বেআইনিভাবে ১৪৫ জনকে আটক করেছে, যাদের অনেককে এখন কেৎজিয়েত কারাগারে ভয়াবহ অবস্থায় রাখা হয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ মারধরের শিকার হয়েছেন, কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হচ্ছে না, আবার অনেকে ঠিকভাবে চিকিৎসাও পাচ্ছেন না। সংগঠনটি আশা প্রকাশ করেছে যে আজই তাঁদের মুক্তির বিষয়ে আদালতে শুনানি হতে পারে, কিন্তু ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাঁদের আইনি সুবিধা পাওয়ার পথে নানা বাধা তৈরি করছে।
ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন নতুন কিছু নয়। ২০১০ সালেও এমন একটি নৌবহর গাজা অভিমুখে যাত্রা করেছিল। তখনও ইসরায়েলি বাহিনী তাদের ওপর হামলা চালায়, নয়জন কর্মী নিহত হন। সেই ঘটনার পরও এই আন্দোলন থামেনি। কারণ, গাজার মানুষ এখনো অবরুদ্ধ, এখনো খাদ্য ও চিকিৎসা ঘাটতিতে ভুগছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় শিশুরা এখনো ভয় পায় আকাশে বোমার শব্দ শুনে। ফ্লোটিলা আন্দোলনের কর্মীরা মনে করেন, এই ভয়, এই কষ্টের মধ্যেও যদি কেউ মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে পারে, তবে তা মানুষের বিবেক জাগ্রত করবে। কিন্তু ইসরায়েল সেই প্রচেষ্টাকে ভয় হিসেবে দেখছে। তাদের দৃষ্টিতে, এই ধরনের উদ্যোগ আন্তর্জাতিকভাবে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তাই তারা কঠোর অবস্থান নিচ্ছে।
শহিদুল আলম বাংলাদেশের একজন পরিচিত মুখ। তিনি শুধু একজন আলোকচিত্রী নন, মানবাধিকারের পক্ষের একজন সোচ্চার কণ্ঠও বটে। ২০১৮ সালে তিনি নিজ দেশেও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সরকারবিরোধী বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে। এরপর তিনি আবারো মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, গাজার নিপীড়িত মানুষের পাশে থেকেছেন। তাঁর পরিবার ও সহকর্মীরা এখন গভীর উদ্বেগে আছেন। দৃক থেকে জানানো হয়েছে, তাঁরা নিয়মিত আদালাহর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর সহায়তা চাইছেন যাতে শহিদুল আলমসহ অন্যদের নিরাপদে মুক্তি নিশ্চিত করা যায়।
এই ঘটনার সময় গাজা যুদ্ধবিরতির আলোচনাও নতুন করে গতি পেয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, ইসরায়েল ও হামাস প্রথম ধাপে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছেছে। তাঁর ভাষায়, এটি হবে “একটি শক্তিশালী ও স্থায়ী শান্তির প্রথম পদক্ষেপ।” চুক্তি অনুযায়ী, ইসরায়েল ধীরে ধীরে তাদের সেনাদের গাজা থেকে সরিয়ে নেবে, আর হামাস কিছু জিম্মি ও বন্দিকে মুক্তি দেবে। কিন্তু এই ঘোষণা আসার পরপরই ইসরায়েলের এক কট্টরপন্থী মন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচ বলেছেন, “জিম্মিদের ফেরত আনার পর হামাসকে ধ্বংস করতেই হবে।” তাঁর এই মন্তব্যে অনেকেই বলছেন, যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ আবারও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
গাজায় এখনো অস্থিরতা বিরাজ করছে। চুক্তির অংশ হিসেবে প্রতিদিন ৪০০টি ত্রাণ ট্রাক প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তা এখনো বাধাগ্রস্ত। হামাস জানিয়েছে, তারা ২০ জন জীবিত বন্দী মুক্তি দেবে, আর নিহত জিম্মিদের মরদেহ পরবর্তী ধাপে ফেরত দেওয়া হবে। বিনিময়ে ইসরায়েল কয়েক শ ফিলিস্তিনি বন্দী মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে। এদিকে ইসরায়েল বলছে, তারা ৭০ শতাংশ এলাকা থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে, যা গাজার মানুষের জন্য কিছুটা স্বস্তি বয়ে আনতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা ও উগ্রপন্থীদের বক্তব্যের কারণে সেই আশার আলো এখনো ক্ষীণ।
এ অবস্থায় শহিদুল আলম ও তাঁর সহযাত্রীদের বন্দিত্ব যেন এই সংঘাতের প্রতীক হয়ে উঠেছে। যারা শান্তির জন্য যাত্রা শুরু করেছিলেন, এখন তারাই হয়ে গেছেন যুদ্ধের শিকার। তাঁদের মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে মানবাধিকারকর্মীরা আওয়াজ তুলেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে #FreeShahidulAlam প্রচারণা। অনেকেই বলছেন, এটি শুধু একজন মানুষের মুক্তির দাবি নয়, বরং মানবতার পক্ষে এক আওয়াজ।
গাজার এই যুদ্ধ, বন্দিত্ব আর শান্তির স্বপ্ন—সবকিছু মিলে যেন এক জটিল বাস্তবতা তৈরি করেছে। একদিকে চলছে কূটনৈতিক আলোচনার প্রচেষ্টা, অন্যদিকে বন্দিত্বে কাতর মানুষগুলো মানবতার প্রতি আস্থা হারাতে বসেছে। শহিদুল আলম ও তাঁর সহযাত্রীরা সেই হারানো আস্থার প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাঁদের মুক্তি শুধু কয়েকজন কর্মীর নয়, এটি বিশ্বের সেই অংশের জয়ের প্রতীক হতে পারে, যারা এখনো বিশ্বাস করে—শান্তি সম্ভব, যদি মানুষ মানবতার পাশে দাঁড়ায়।
আপনার মতামত জানানঃ