অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলেছে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার সংশোধিত সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহার করে রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন-পীড়নে নামছে। সংস্থার অভিযোগ, বিশেষ করে আওয়ামী লীগপন্থিদের বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ করে নির্বিচারে গ্রেফতার চালানো হচ্ছে, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহনশীলতা ও মানবাধিকার চর্চার জন্য ভয়াবহ সংকেত বহন করছে।
২০২৪ সালের অগাস্টে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। সে সময় তিন সপ্তাহব্যাপী ব্যাপক সহিংসতায় প্রায় এক হাজার চারশ মানুষ নিহত হয় বলে জানায় এইচআরডব্লিউ। এরপর থেকেই দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গ্রেফতার অভিযান বেড়ে যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের মে মাসে সরকার সংশোধিত সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রণয়ন করে এবং সেই আইন ব্যবহার করেই আওয়ামী লীগকে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। দলটির সমর্থনে যেকোনো সভা, প্রকাশনা বা অনলাইন মন্তব্যও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেছেন, “রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কারাগারে পাঠানো কিংবা মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়া—এই ধরনের কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি করা উচিত নয়। শেখ হাসিনার সময় যেমন হয়েছিল, ইউনূস সরকারের এমন আচরণ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য হুমকি।” সংস্থাটি জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরকে আহ্বান জানিয়েছে, যেন তারা নির্বিচারে আটক ব্যক্তিদের মুক্তির দাবিতে সরব হয় এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত গ্রেফতারের ঘটনাগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের অনেকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ কেবল সন্দেহের ভিত্তিতে। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। এই অভিযোগগুলো শেখ হাসিনার আমলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর কথাই মনে করিয়ে দেয়।
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি আলোচনাসভা থেকে সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ ও সাবেক রাজনীতিবিদদের আটক করার ঘটনাও প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে। ২৮ আগস্ট “মঞ্চ ৭১” নামে একটি সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আলোচনাসভার আয়োজন করেছিল। সভায় অংশ নেওয়া ১৬ জনকে পুলিশ আটক করে, যাদের মধ্যে ছিলেন প্রবীণ রাজনীতিক আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান। পুলিশের দাবি ছিল, তাদের নিরাপত্তার জন্য আটক করা হয়েছে, কিন্তু পরে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেফতার দেখানো হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি অভিযান।
আটক সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্নাকে আদালতে নেওয়ার সময় হেলমেট, হাতকড়া এবং বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরিয়ে আনা হয়—যা ছিল অযৌক্তিক ও অপমানজনক। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা তখন আরেক সাংবাদিকের ওপর হামলা চালান। এই ঘটনা বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বলে মন্তব্য করেছে সংস্থাটি।
একজন আটক ব্যক্তির পরিবারের সদস্য হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, “এটি কোনো রাজনৈতিক সভা ছিল না, তবু সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আনা হয়েছে। যারা হামলা চালিয়েছে, তারা এখনো মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতে মনে হচ্ছে, সরকার শুধু মুখ বদলেছে, পদ্ধতি বদলায়নি।”
এইচআরডব্লিউ তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনটি ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রণীত হয়। সেই সময় এই আইনের অপব্যবহার নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। ইউনূস সরকার দাবি করেছিল, সংশোধনের উদ্দেশ্য ছিল আগের অপব্যবহার বন্ধ করা, কিন্তু বাস্তবে এখন একই আইন ব্যবহার করে রাজনৈতিক দমন চলছে। সম্পাদক পরিষদও এই আইন নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে, কারণ এটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত করতে পারে। যদিও অধ্যাপক ইউনূস এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন, তাঁর সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
মানবাধিকার সংস্থাটি আরও অভিযোগ করেছে, সরকার রক্ষণশীল মুসলিম গোষ্ঠীগুলোকেও নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। এসব গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে সহিংসতা চালাচ্ছে এবং সাধারণ মানুষ হামলার শিকার হচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল জনতার হামলায় অন্তত ১৫২ জন নিহত হয়েছেন। এতে বোঝা যায়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের দুর্বলতা রয়েছে।
একজন রাজনৈতিক কর্মী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, “এখন আমাদের সামনে দুটি পথ—একটি হলো সন্ত্রাসবাদীর তকমা নিয়ে কারাগারে যাওয়া, আরেকটি হলো জনতার হামলায় মরতে হওয়া। নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা ছাড়া এই দেশ নিরাপদ হতে পারে না।”
অন্যদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয় বাংলাদেশে তিন বছরের একটি মিশন শুরু করেছে, যার উদ্দেশ্য মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও সহায়তা করা। জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার টুর্ক বলেছেন, এই মিশন বাংলাদেশের জন্য মানবাধিকার প্রতিশ্রুতির প্রতীক হবে এবং এটি পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে কাজ করবে।
তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, এই উদ্যোগ তখনই কার্যকর হবে, যদি সরকার রাজনৈতিক দমন বন্ধ করে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করে। মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেছেন, “সন্ত্রাসবিরোধী আইন এখন রাজনৈতিক দমন-পীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত নিরাপদ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে মনোযোগ দেওয়া, যা বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করবে।”
বাংলাদেশে এখন মানবাধিকার পরিস্থিতি একটি সংবেদনশীল মোড়ে দাঁড়িয়ে। সরকার যদি প্রকৃত অর্থে আইনের শাসন ও নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষা করতে না পারে, তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যেমন ভেঙে পড়বে, তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আপনার মতামত জানানঃ