সরকার ২০টি জে-১০ সিই যুদ্ধবিমান কেনার প্রস্তাব বা উদ্যোগ নিয়েছে; এটিই যদি চূড়ান্ত হয়, তাহলে কাগজপত্র, প্রশিক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণসহ মোট ব্যয় ধরা হয়েছে আনুমানিক ২২০ কোটি ডলারের কাছাকাছি—প্রায় দুই দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার, যা রূপান্তরে বাংলাদেশের মুদ্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকার লেনদেনে দাঁড়াবে। এই চুক্তি বাস্তবায়নের সম্ভাব্য সময় হিসেবে বলা হচ্ছে ২০২৫-২৬ ও ২০২৬-২৭ অর্থবছরগুলোতে, এবং ক্রয় প্রক্রিয়া সরাসরি বা সরকার-টু-সরকার (G2G) চুক্তির মধ্যেই হতে পারে। এই মূল বিবরণটি দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংবাদসংস্থার রিপোর্টে দেওয়া আছে।
এখন প্রশ্ন আসে—কারণ কি? কেন এই মুহূর্তে, এবং কেন জে-১০ সিই? সরকারের পক্ষ থেকে জানানো সাধারণ যুক্তি হচ্ছে: বাংলাদেশ বিমান বাহিনী (বিএএফ)কে আধুনিকায়ন করা ও জাতীয় আকাশ প্রতিরক্ষা শক্তিশালী রাখা। বর্তমান বহরে অনেক বিমান পুরোনো ও সীমিত সক্ষমতার; তাই ৪.৫ প্রজন্মের জে-১০ সিই জাতীয় প্রতিরক্ষা-দৃশ্যকে আপগ্রেড করবে বলে দাবি করা হচ্ছে। এছাড়া জে-১০ সিরিজের কিছু মডেলকে দ্রুত টেক-অফ, উচ্চ ম্যানুভারিং এবং মাল্টি-রোল ক্ষমতার জন্য চিহ্নিত করা হয়—অর্থাৎ এগুলো শুধু প্রতিরক্ষামূলক নয়, আক্রমণাত্মক কাজেও ব্যবহার করা যায়। এই ধরনের প্রযুক্তিগত-নৈপুণ্য এবং বহর-ভারসাম্যের কারণে সবদেশেই নতুন বিমান কেনার সময় এমন যুক্তি আসে।
তবে কেন ‘অন্তর্বর্তী’ সরকার—এই পয়েন্টেই রাজনৈতিক ও নীতিগত প্রশ্ন ওঠে। বড় তথা ব্যয়সাপেক্ষ প্রতিরক্ষা চুক্তি সাধারণত নির্দিষ্ট সময় ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া ভালো, যাতে নির্বাচিত সরকার, পরবর্তী নীতি ও বাজেট দায়িত্ব সঠিকভাবে বিবেচনা করতে পারে—এই যুক্তি সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা তুলে ধরেছেন। তারা বলছেন, যখন একটি সরকার অন্তর্বর্তীকালীন এবং ভোটের খুব কাছাকাছি থাকে, তখন এমন বড় সিদ্ধান্ত পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের ওপর আর্থিক ও কৌশলগত বোঝা হিসেবে পড়তে পারে। ফলে এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তা জাতীয় স্বার্থ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বিবেচনায় রেখে নেয়া উচিত—এমনই সতর্কবার্তা এসেছে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। এই দৃষ্টিভঙ্গিও স্থানীয় রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রযুক্তিগত দিক থেকে জে-১০ সিই সম্পর্কে যা বলা যায়:
এটি একক-ইঞ্জিন, মাল্টি-রোল ফাইটার; কিছু সংস্করণ আধুনিক এএসইএ, হেলমেট-মাউন্টেড সিস্টেম ও উন্নত রাডার ধারণ করে; ম্যানুভারিং-ক্ষমতা ভালো হওয়ায় ‘টপ-ফাইট’ বা কাছ থেকে লড়াই করার ক্ষেত্রে সুবিধা; এবং এটি অন্যান্য ক্ষেপণাস্ত্র বা ব্রত নিয়ে কাজ করতে পারে। তবে এই সব ক্ষমতার বাস্তব মূল্যায়ন নির্ভর করে যে মডেলটি কেনা হচ্ছে, কেমন সেন্সর-প্যাকেজ ও বাস্তব যুদ্ধাবস্থায় পরীক্ষিত কার্যকারিতা—এগুলো একইরকম নয় সব রফতানি সংস্করণের ক্ষেত্রে। আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিমানের তুলনায় জে-১০-এর শক্তি-দিক ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে সেনাবাদী বিশ্লেষকরা বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন; তাই কেবল মডেলের নাম দেখে পুরো ছবি আঁকা ঠিক হবে না।
অর্থনীতি ও বাজেটগত হিসাবও বড় প্রশ্ন। আনুমানিক ২২০ কোটি ডলার—এটি কেবল বিমান কেনাই নয়; এতে প্রশিক্ষণ, স্পেয়ার পার্টস, লজিস্টিক-সাপোর্ট, ইঞ্জিন-সার্ভিসিং, সম্ভাব্য লাইফ-সাইকেল রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি খরচও থাকে। দীর্ঘ মেয়াদে এই ফাইনেনশিয়াল বোঝা বাজেট পরিকল্পনায় ঢোকে—অর্থাৎ দফায়-দফায় অর্থপ্রদানে (ইনস্টলমেন্ট), রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, আধুনিকায়ন ইত্যাদি সব মিলিয়ে পরবর্তী দেওয়া বাজেটে বড় অংশ আটকে যেতে পারে। বিশেষ করে একটি উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাহিদাও আছে; তাই এই ব্যয়ের অগ্রাধিকারের বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত হতে স্বাভাবিক। স্থানীয় সংবাদগুলো এই আর্থিক চাহিদার পরিমাপ তুলে ধরেছে।
ভোটের আগে এমন সিদ্ধান্ত নিলে রাজনৈতিক প্রসঙ্গও তীব্র হয়। বিরোধী-শিবির, নাগরিক অংশ এবং অ্যানালিস্টরা বলেন—নির্বাচনসংক্রান্ত সময়ে অনুকূল সাড়া পাওয়ার উদ্দেশ্য থাকতে পারে, বা কোনো রাজনৈতিক কৌশলগত উদ্দেশ্য কাজ করে থাকতে পারে; আবার কেউ বলছেন জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্র রাজনৈতিক পারদায় নয়—স্বাভাবিকভাবেই সবাই এতে সন্দিহান। অপরদিকে ত্বরিতভাবে প্রতিরক্ষার সক্ষমতা বাড়ানো এক ধরনের বাস্তবস্তরে দায়িত্বও বলে কিছু বোর্ডে যুক্তি রাখা হয়—যদি বাহিনী সত্যিই পুরনো ও খর্ব ব্রন হলে তা না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা সঠিক নাও হতে পারে। এই দুইদিকের মধ্যেই জনসমালোচনা ও সরকারী যুক্তি লড়াই করে। স্থানীয় বিশ্লেষণগুলো এসব দ্বয়াত্মক যুক্তিই তুলে ধরে।
আঞ্চলিক দৃষ্টিকোণও আছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বড় দেশগুলোর অস্ত্রচালনা ও জোটের ভারসাম্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। কোনো দেশ যদি নির্দিষ্ট উৎস থেকে বড়খাট্টা অস্ত্র সংগ্রহ করে, তা প্রতিবেশীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে; ফলে কড়া কূটনীতি, সম্পর্ক ও পরোক্ষ চাপও কাজ করতে পারে। বিশেষ করে চীন-যুক্ত রেখে প্রতিরক্ষা কেনাকাটা করলে পশ্চিমা দেশগুলো বা প্রতিবেশী দেশগুলো উদ্বিগ্ন হতে পারে। অন্যদিকে চীন থেকে সরাসরি সামরিক সরবরাহ পেলে কৌশলগত সঙ্গতি, প্রশিক্ষণসহ লজিস্টিক-সাপোর্ট সহজ হতে পারে—এটাই কেন কখনও দেশগুলো দ্রুত চীনা অস্ত্রপত্রকে বেছে নেয়। এই ভূ-রাজনৈতিক ব্যাখ্যাগুলো স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নিবন্ধে আলোচনা হয়েছে।
আবার কর্মঘট ও রক্ষণাবেক্ষণ-প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত বাস্তব সমস্যা আছে। নতুন বিমান আনার পর দ্রুত পাইলট প্রশিক্ষণ, মেইনটেন্যান্স কর্মী প্রস্তুত করা, চাইলে স্থানীয় সরঞ্জাম ও পার্টস-স্টক তৈরি করা—এগুলো সময় সাপেক্ষ ও খরচসাপেক্ষ কাজ। বিদেশি সূত্রে স্পেয়ার পার্টস ও ইঞ্জিন-সাপোর্ট যদি সময়মতো না মেলে বা বাইরের চাহিদা বেশি হয়, তাহলে সেবা-নির্ভরতা সমস্যাও হতে পারে। তাই কেবল বিমানের ক্ষমতা নয়, পুরো ইকোসিস্টেম-সাপোর্ট বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া জোরালোভাবে শর্ত। সংবাদ আলোচনায় এই বাস্তব সমস্যা-দিকগুলোও উঠে এসেছে।
সবশেষে, সিদ্ধান্তটি কীভাবে চূড়ান্ত হবে সে প্রসঙ্গও বিতর্কিত। সরকারি-প্রতিবন্ধ এবং জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি, অর্থ দফতর, সংসদীয় তদারকি—এগুলো সাধারণত বড় প্রতিরক্ষা প্রজেক্টকে মূল্যায়ন করে। যদি চূড়ান্ত অনুমতি আসে, তা কবে, কী শর্তে এবং অর্থায়ন কিভাবে হবে—এসব প্রশ্ন জনগণের সামনে স্পষ্ট হওয়া দরকার। আর যদি বিকল্প-মডেল বা বিকল্প সরবরাহকারীর কথা থেকেও বিবেচনা করা না হয়, তা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে জনগণ ও বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলবেন। স্থানীয় সংবাদ ও বিশ্লেষণে এই প্রশ্নগুলোই সবচেয়ে বেশি প্রতিধ্বিত হচ্ছে।
সংক্ষেপে বলা যায়—এই প্রস্তাবের পেছনে বাস্তবতবোধ আছে: বিমানবাহিনীকে আধুনিক করা এবং আকাশ প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করা দরকার। কিন্তু সময় (অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ও নির্বাচন), ব্যয়-ভার, কৌশলগত প্রভাব, রক্ষণাবেক্ষণ-প্রশিক্ষণ ও জাতীয় রাজনৈতিক বৈধতা—এই সবকিছু মিলিয়ে এটি একটি জটিল সিদ্ধান্ত। তাই জনস্বার্থে এবং নিরাপত্তা-নীতিতে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও পর্যালোচনা থাকা উচিত—ন শুধু মিডিয়া স্ট্যাটাস বা প্রথম প্রস্তাবেই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা। উপরে যে খবরগুলো প্রকাশ হয়েছে এবং জে-১০-এর প্রযুক্তিগত ও আর্থিক বিবরণ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে পাওয়া যায়।
আপনার মতামত জানানঃ