হাসিনা ধর্মনিরপেক্ষতাকে হত্যা করেছেন, আর ইউনুস সেটাকে দাফন করেছেন। আওয়ামী লীগ সব সময় নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে দেখিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তাদের সময়েই দেশে ইসলামপন্থার প্রভাব অনেক বেড়েছে। এই ভান করা ধর্মনিরপেক্ষতা ইসলামপন্থীদের একটা সুযোগ দিয়েছে নিজেদেরকে “নিপীড়িত” হিসেবে উপস্থাপন করার। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের বিরোধিতা না করে বরং তাদের পক্ষ নিচ্ছে, যার ফলে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা পুরোপুরি হারিয়ে যাচ্ছে।
হাসিনার পতনের পর অনেকে বলতে শুরু করে যে আওয়ামী লীগ ইসলামবিরোধী ছিল। ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলো এই ধারণাকে “ধর্মনিরপেক্ষ ফ্যাসিবাদ” বলে ছড়াতে থাকে, এবং তা সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের ভারতপ্রীতি, ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, আর ভারতের মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের খবর – সব মিলিয়ে মানুষ ভাবতে শুরু করে যে ভারতপন্থী মানেই ইসলামবিরোধী। জামায়াতের বিরুদ্ধে দমনকে আওয়ামী লীগ জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে চালালেও, জামায়াত সেটা “ইসলামের বিরুদ্ধে আক্রমণ” হিসেবে তুলে ধরে। আবার বাংলাদেশের মতো রক্ষণশীল দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে অনেকেই নাস্তিকতা বলে মনে করে, তাই বিষয়টি সহজেই ইসলামবিরোধিতার সঙ্গে গুলিয়ে যায়।
আওয়ামী লীগ মুখে বলত তারা ধর্মনিরপেক্ষ, কিন্তু বাস্তবে তারা ইসলামিকরণকেই বাড়িয়েছে। ২০১৮ সালে জার্মান গবেষক জাসমিন লর্শ বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন বাংলাদেশে ইসলামপন্থার প্রভাব বেড়েছে। তিনি বলেন, ইসলামপন্থী আন্দোলনের উত্থান, তীব্র রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, আর আধা-স্বৈরাচারী শাসন — এই তিনটি কারণ একসঙ্গে থাকলে “ধর্মনিরপেক্ষ” সরকাররাও ইসলামিকরণকে ত্বরান্বিত করে। বাংলাদেশে তিনটিই ছিল।
২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের উত্থান হয়, যারা শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র চায়। আওয়ামী লীগ তাদের সঙ্গে আপস করে। ২০১৬ সালে হেফাজতের দাবিতে পাঠ্যবই থেকে শরৎচন্দ্র, হুমায়ুন আজাদসহ অনেক লেখকের রচনা বাদ দেওয়া হয়। নাস্তিক লেখক ও মুক্তচিন্তকদের হত্যার ঘটনায় সরকার প্রায় কিছুই করেনি। বরং মন্ত্রীরা বলেছিলেন, কেউ যেন আল্লাহ বা নবীকে সমালোচনা না করে। হাসিনা নিজেও বলেছিলেন, তিনি মদিনা সনদের আদর্শে দেশ চালাবেন। ২০১৭ সালে হেফাজতের দাবিতে সুপ্রিম কোর্ট থেকে লেডি জাস্টিসের মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়।
কওমি মাদ্রাসার ডিগ্রিকে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় সমমান দেয়, যার ফলে ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রভাব বেড়ে যায়। ২০১৮ সালের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ধারা যোগ হয়, যা দিয়ে রিতা দেওয়ানের মতো মানুষদের গ্রেপ্তার করা হয়। নির্বাচনের সময় প্রায় সব ইসলামপন্থী দল আওয়ামী লীগের জোটে বা সহযোগী দলে যুক্ত হয়। ফলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করেনি, বরং ইসলামপন্থাকে রাজনীতির মূলধারায় এনেছে।
ইসলামপন্থীরা এখন নিজেদেরকে হাসিনার সরকারের “নিপীড়িত” হিসেবে দেখিয়ে জনসমর্থন নিচ্ছে। কিন্তু সত্য হলো, আওয়ামী লীগ সব বিরোধী দলকেই দমন করেছে, শুধু ইসলামপন্থীদের নয়। তবুও ইসলামপন্থীরা নিজেদেরকে একমাত্র ভিকটিম হিসেবে দেখিয়ে নৈতিক সুবিধা নিচ্ছে। এই কৌশল শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতে ডানপন্থীরা ব্যবহার করে। যেমন আমেরিকায় ট্রাম্পপন্থীরা বলে, তারা নাকি “ওয়োক সংস্কৃতির শিকার”; ভারতে বিজেপি বলে, “হিন্দুরা বঞ্চিত”; ঠিক তেমনি বাংলাদেশে ইসলামপন্থীরা বলে, তারা নাকি আওয়ামী লীগের শাসনে ভোগান্তির শিকার।
বাংলাদেশ ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে একনায়কতন্ত্র থেকে মুক্তি পেয়েছে। এখন অতীতকে সৎ ও যুক্তিসঙ্গতভাবে দেখা দরকার। কিন্তু যদি কেউ বলে আওয়ামী লীগ সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ ছিল, বা ইসলামপন্থীরাই একমাত্র ভিকটিম ছিল, তাহলে সেটা ইতিহাস বিকৃতি। আজ ইসলামপন্থীরা ১৯৭১ সালের পর সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় আছে। তারা যদি এতই নিপীড়িত হতো, তবে এত ক্ষমতা কোথা থেকে এল? এটা সম্ভব হয়েছে আওয়ামী লীগের তোষণনীতির কারণে।
কিন্তু দায় শুধু আওয়ামী লীগের নয়। মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও ইসলামপন্থীদের চাপে নতি স্বীকার করছে। আগস্টের পর থেকে “তওহিদি জনতা” প্রায় ১৮০টির মতো মাজারে হামলা করেছে। দুর্গাপূজার প্রতিমা ভাঙা হয়েছে অনেক জায়গায়। এক কলেজের অধ্যাপক নারী উত্তরাধিকারের পক্ষে লেখার জন্য বদলি হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফাকে পাঠ্যবই কমিটি থেকে ইসলামপন্থীদের দাবিতে সরানো হয়েছে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রীর হয়রানির অভিযোগে আটক ব্যক্তিকে জনতার দাবিতে ছাড়াও দেওয়া হয়েছে। চরমপন্থী জসিমউদ্দিন রহমানির মতো ব্যক্তিরা মুক্তি পেয়ে আবারও সক্রিয় হয়েছেন।
সরকার এসবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিয়ে বরং বলছে, এগুলো নাকি “ভারতের প্রপাগান্ডা”। ফলে এখন ইসলামপন্থীরাই রাষ্ট্রকে বলে দিচ্ছে কী হবে, কী হবে না।
যেকোনো সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা ও নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়া। এই জায়গায় ইউনুস সরকার ব্যর্থ হয়েছে। দেশে এখন আইন নয়, ইসলামপন্থী জনতার কথাই শেষ কথা হয়ে যাচ্ছে। যদি এই প্রভাব বন্ধ না করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা সত্যিই শেষ হয়ে যাবে। সূত্র: নেত্র নিউজ।
আপনার মতামত জানানঃ