বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে আওয়ামী লীগকে সবসময়ই একটি প্রভাবশালী ও মূলধারার রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দেখা হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা দলটির রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দলটি এমন এক সংকটময় অবস্থায় পড়েছে, যেখানে তাদের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা চলছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম চলমান থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের সমর্থকরা নীরব হয়ে নেই। তারা রাজপথে নানা কর্মসূচি পালন করছে, মিছিল করছে, ঝটিকা কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ অবস্থায় বিশ্লেষকরা বলছেন, দলটির বর্তমান রাজনৈতিক কৌশল অনেকটা জামায়াতে ইসলামী যেভাবে অতীতে দমন-পীড়নের মুখে নিজেদের সংগঠন টিকিয়ে রেখেছিল, তার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় গত এক মাসে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঝটিকা মিছিল করেছে। কখনো মতিঝিল, কখনো শ্যামলী, আবার কখনো বাংলামোটর বা গুলশানে তারা হঠাৎ জড়ো হয়ে মিছিল বের করছে। কয়েক মিনিট ধরে স্লোগান দিয়ে দ্রুত সটকে পড়ছে। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে তাদের ধরপাকড় করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এ ধরনের কার্যক্রম অতীতে জামায়াতে ইসলামী অনেকবার ব্যবহার করেছে। দমন-পীড়নের সময়ে জামায়াতের নেতাকর্মীরাও হঠাৎ জড়ো হয়ে ছোট ছোট মিছিল করত এবং দ্রুত ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত। আওয়ামী লীগও এখন একই কৌশল নিচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
আওয়ামী লীগের বর্তমান সংকটের পেছনে রয়েছে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান, যেখানে দলটির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ ওঠে। সরকার দলটির সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে, আর শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর ফলে দলটি সংগঠিতভাবে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ হারায়। তবুও এত বড় রাজনৈতিক দলের কোটি কোটি সমর্থককে চুপ করিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। তারা ভিন্ন পথে নিজেদের সক্রিয়তা দেখাচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সরকারের লক্ষ্য আওয়ামী লীগকে নিধন করা। আদালত প্রাঙ্গণে মব তৈরি করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হচ্ছে। এমন প্রতিকূল অবস্থায় আওয়ামী লীগকে টিকে থাকার জন্য নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হচ্ছে। তার বক্তব্যে স্পষ্ট, দলটি এখন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে কাজ করছে।
এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগও জামায়াতের মতো একটি শক্তিশালী যোগাযোগ নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। কোথায় কখন কর্মসূচি হবে, সেটি আগে থেকে ঘোষণা না দিয়ে শেষ মুহূর্তে জানানো হচ্ছে। এতে গোপনীয়তা বজায় থাকে, আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বিভ্রান্ত হয়। একইসঙ্গে দলটি একটি ডাটাবেজভিত্তিক কাঠামো তৈরি করছে, যাতে দেশজুড়ে নেতাকর্মীদের সক্রিয় করা যায়। এই ধরণের সাংগঠনিক পরিকল্পনা অতীতে জামায়াতও ব্যবহার করেছিল।
রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য এ ধরনের কৌশল অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায় যখন দলটি নিষিদ্ধ হয় বা প্রবল দমন-পীড়নের শিকার হয়। জামায়াত ইসলামীর অভিজ্ঞতা থেকে শেখা যায়, তারা প্রকাশ্যে না এলেও সংগঠনকে ভেতরে ভেতরে সচল রেখেছিল। ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে তারা কর্মীদের সক্রিয় রাখত। এখন আওয়ামী লীগও একই পথ অনুসরণ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এখানে একটি প্রশ্ন উঠে আসে—এটি কি আওয়ামী লীগের নিজস্ব কৌশল, নাকি বিদেশি কোনো শক্তির প্রভাব রয়েছে? ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমদ মনে করেন, আওয়ামী লীগের এই সক্রিয়তার পেছনে বিদেশি ইন্ধন থাকতে পারে। তবে তিনি এটিও বলেছেন, এটা এখনই বলা কঠিন। হয়তো তারা জামায়াতের কৌশল নিচ্ছে, হয়তো নিজেদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছে। তবে একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, আওয়ামী লীগ বর্তমানে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে এবং এটি দৃশ্যমান।
অন্যদিকে বিএনপির নেত্রী রুমিন ফারহানা মনে করেন, জামায়াত একসময় টিকে থাকার রাজনীতি করেছে, এখন আওয়ামী লীগও একই কাজ করছে। তবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক মিছিলগুলো যথেষ্ট বড় ছিল, সেগুলো গুপ্ত বা গোপন রাজনীতির মতো মনে হয়নি। বরং সেগুলো অনেকটাই প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মসূচির মতোই হয়েছে।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ অতীতে জামায়াতকে সবসময় সমালোচনা করেছে তাদের গোপনীয় রাজনীতি, ঝটিকা মিছিল আর সাংগঠনিক গোপন কার্যক্রমের জন্য। অথচ আজ একই পথ ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক বাস্তবতা বদলালে কৌশলও বদলায়। যেটি একসময় সমালোচিত ছিল, সেটিই এখন প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজনৈতিক টিকে থাকার জন্য এ ধরনের কৌশল কার্যকর হলেও প্রশ্ন রয়ে যায় দীর্ঘমেয়াদে এর ফলাফল কী হবে। জামায়াত ইসলামী তাদের গোপন কার্যক্রম চালিয়ে টিকে থাকলেও মূলধারার রাজনীতিতে তাদের প্রভাব অনেকটা ক্ষীণ হয়ে যায়। তারা আর বড় কোনো গণভিত্তি গড়ে তুলতে পারেনি। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও ঝুঁকি আছে, গোপন মিছিল বা ঝটিকা কর্মসূচির মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা রাখা গেলেও তা কি মূলধারার রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকিয়ে রাখতে পারবে?
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের বিপুল সমর্থকগোষ্ঠী রয়েছে। সারা দেশে তাদের কোটি কোটি সমর্থক ও কর্মী আছেন। এমন পরিস্থিতিতে দলটি একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে, এটি বাস্তবসম্মত নয়। তাদের এই বিপুল জনশক্তি দলটিকে টিকে থাকার শক্তি জোগাচ্ছে। এর ফলে তারা হয়তো ভিন্ন কৌশলে রাজনীতি করছে, কিন্তু রাজনীতি একেবারে হারিয়ে ফেলছে না।
এই প্রেক্ষাপটে আরেকটি দিক গুরুত্বপূর্ণ—আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এখন দেশের বাইরে থেকে নির্দেশনা দিচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। দেশের ভেতরে আত্মগোপনে থাকা নেতাদের মাধ্যমে সংগঠন চালানো হচ্ছে। নির্দেশনা বাইরে থেকে আসছে, যা সংগঠনের ভেতরে সমন্বয় তৈরি করছে। এ ধরণের কৌশলও অনেকটা জামায়াতের অতীত কৌশলের সঙ্গে মিলে যায়।
এভাবে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ বর্তমানে একধরনের “গোপন রাজনীতি” করছে। তারা প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ করছে না, বরং হঠাৎ মিছিল, হঠাৎ প্রতিবাদ করছে। এর মাধ্যমে তারা টিকে থাকার বার্তা দিচ্ছে। তাদের বার্তা হচ্ছে—যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আওয়ামী লীগ রাজপথে আছে, সংগঠন সচল আছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, আওয়ামী লীগের এই টিকে থাকার রাজনীতি ভবিষ্যতের নির্বাচনের দিকেই ইঙ্গিত করছে। তারা চায় নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে রাজপথে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে। মিছিল ও ঝটিকা কর্মসূচি সেই অবস্থান জানান দেওয়ার কৌশল। তবে একইসঙ্গে এটি ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ সরকারের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে এ ধরনের কার্যক্রম দলটির ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
অতএব, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ নতুন এক বাস্তবতায় দাঁড়িয়েছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ, শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে, কিন্তু তবুও তারা রাজনীতি করছে। এ রাজনীতি অনেকাংশে জামায়াতের অতীত কৌশলের অনুরূপ, যদিও আওয়ামী লীগ একে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করছে। রাজনীতিতে টিকে থাকার এই সংগ্রাম তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে—তারা আবার মূলধারায় ফিরতে পারবে কিনা, নাকি জামায়াতের মতো প্রান্তিক হয়ে যাবে, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।
আপনার মতামত জানানঃ