বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঘিরে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে যে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে, সেটি একটি বহুমাত্রিক বাস্তবতার প্রতিফলন। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সেনাবাহিনী মাঠে রয়েছে, যা সাধারণত দেখা যায় না। সেনাদের বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে, কিন্তু এই দীর্ঘ উপস্থিতি নানা প্রশ্ন তুলছে—তাদের ভূমিকা কি সংবিধান ও সামরিক নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, নাকি তারা রাজনৈতিক সংঘাতে অতিরিক্ত সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে?
ঢাকার কাকরাইলের সাম্প্রতিক সংঘর্ষে গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের ওপর সেনা ও পুলিশের লাঠিপেটার ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে দলের সভাপতি নুরুল হক নুর গুরুতর আহত হওয়ায় বিষয়টি রাজনৈতিক রূপ নিয়েছে। গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁনের অভিযোগ, এটি ছিল পরিকল্পিত হামলা, যেখানে সেনাদের নেতৃত্বে নির্বিচারে নির্যাতন চালানো হয়েছে। নুরকে লক্ষ্য করে হামলার অভিযোগে রাজনৈতিক মহলে বিশ্বাস জন্মেছে যে, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল দমনে সেনা বাহিনী ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে সেনা সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে বিপরীত চিত্রও দেখা গেছে। যেমন, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে খুলনায় এক তরুণকে গণপিটুনি দেওয়া হলেও সেনারা প্রথমে কঠোর অবস্থান নেননি, বরং ঘটনার শেষ দিকে আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেন। মানবাধিকারকর্মীদের মতে, কখনো অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ আর কখনো অসহায় দাঁড়িয়ে থাকার এই বৈপরীত্য সেনাদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে—এটি কি তাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, নাকি স্পষ্ট নির্দেশনার অভাবের কারণে তারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন?
অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম মনে করেন, মূল সমস্যাটি হলো স্পষ্ট নির্দেশনার অভাব। সেনাদের প্রশিক্ষণ অনুযায়ী তাদের সামনে যদি স্পষ্ট কমান্ড ও নির্দেশনা না থাকে, তবে তারা একেক পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখাবে। একই ঘটনার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া তাদের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, সেনাদের যদি পরিষ্কার কর্মপরিধি না দেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তাদের উপস্থিতি আরও বিতর্কিত হয়ে উঠবে।
অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম মনে করেন, সমস্যা কেবল সেনাদের নয়, সরকারের অবস্থানও অস্পষ্ট। অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে মব সহিংসতা বা রাজনৈতিক বিক্ষোভ মোকাবিলা করবে, সে বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট নীতি নেই। ফলে মাঠে থাকা বাহিনী বিভ্রান্ত হচ্ছে। এ অস্পষ্টতা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্ম দিচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের মনে অবিশ্বাস বাড়াচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর কঠোর অবস্থান গোপালগঞ্জের ঘটনায়ও দেখা গেছে, যেখানে সংঘর্ষ চলাকালে গুলি চালিয়ে কয়েকজন প্রাণ হারান। এ ধরনের ঘটনায় সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা, সেই প্রশ্নও উঠছে। আবার অন্যদিকে, গণপিটুনির মতো ঘটনায় নিরপেক্ষ বা দুর্বল প্রতিক্রিয়া দেখা গেলে সেনাদের নিরপেক্ষতা নিয়েও সংশয় জন্মায়।
বাস্তবতা হলো, পুলিশ বাহিনী এখনো পুরোপুরি পুনর্গঠিত হয়নি। পাঁচই অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর তাদের কার্যক্ষমতা ভেঙে পড়ায় সরকার সেনাদের মাঠে নামায়। সরকারের আশ্বাস ছিল তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে এবং সেনাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও মব সহিংসতা থামেনি। ফলে সেনাদের মাঠে রাখা ছাড়া বিকল্প দেখছে না সরকার।
তবে এই দীর্ঘস্থায়ী উপস্থিতি সেনাদের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি ক্ষয় করছে। সেনাবাহিনী সাধারণত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিশেষ সংকটে জনগণের আস্থা অর্জন করেছে। কিন্তু রাজনৈতিক সংঘাত দমনে জড়িত হওয়ায় সেই আস্থায় ফাটল ধরছে। আইএসপিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা কেবল সরকারের “জিরো টলারেন্স নীতি” বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু যখন সরকারের ভেতরেই ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য শোনা যায়, তখন সেনাদের ওপর ওঠা অভিযোগ আরও জোরালো হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দায় কার? সেনারা কি নিজ সিদ্ধান্তে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করছে, নাকি সরকারের অস্পষ্ট নীতি তাদের বাধ্য করছে ভিন্ন ভিন্ন পদক্ষেপ নিতে? বিশ্লেষকদের মতে, মূল দায় সরকারের। কারণ আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সেনাদের স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এতে সেনারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে চরম পদক্ষেপ নিচ্ছে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় থেকেছে।
এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সেনাবাহিনী ও সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমতে থাকবে। একদিকে রাজনৈতিক দলের অভিযোগ বাড়বে যে সেনারা তাদের দমন করছে, অন্যদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মহলেও সমালোচনা হবে। দীর্ঘমেয়াদে এটি দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অশনিসঙ্কেত।
সমাধান হতে পারে কেবল পরিষ্কার নির্দেশনা ও নীতির মাধ্যমে। সরকারকে স্পষ্ট করে জানাতে হবে কোন পরিস্থিতিতে সেনারা কীভাবে পদক্ষেপ নেবে। অন্যথায় সেনাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া উচিত, কারণ অনিশ্চয়তার মধ্যে সেনাদের মাঠে রাখা তাদের ভাবমূর্তি ও দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
এভাবে দেখা যায়, সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বিতর্কের মূল কারণ হলো দ্বিধাগ্রস্ত নির্দেশনা, সরকারের অস্পষ্ট নীতি, এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা। যদি এ সংকট দ্রুত সমাধান না হয়, তবে বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি একটি দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের জন্ম দিতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ