বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই নতুন নতুন বিতর্কের জন্ম হচ্ছে। রাজনীতির মঞ্চে তোলা হচ্ছে এমন সব দাবি, যেগুলোর বাস্তবতা ও প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন। এরই মধ্যে একটি বিতর্কিত প্রস্তাব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে—ভোটের সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালুর দাবি।
এই দাবি এসেছে মূলত ইসলামপন্থী দলগুলোর কাছ থেকে, যারা দীর্ঘদিন ধরে সংসদে উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি গড়তে ব্যর্থ হয়েছে। তবে বিষয়টি এখন আর শুধু তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; এই দাবিকে ঘিরে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যদি এই পদ্ধতি বাস্তবায়িত হয়, তবে পতিত আওয়ামী লীগ ভিন্ন নামে আবারও সংসদে ফিরে আসতে পারে—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতিতে প্রত্যক্ষভাবে প্রার্থী নয়, ভোট পড়ে রাজনৈতিক দলের পক্ষে। দলসমূহ যে পরিমাণ ভোট পায়, সেই অনুপাতে তারা আসন পায় সংসদে। এই পদ্ধতিতে ব্যক্তি জনপ্রতিনিধিত্বের গুরুত্ব কমে যায় এবং দলের পছন্দমতো প্রার্থী সংসদে যায়। অনেক দেশে এই পদ্ধতির প্রয়োগ আছে, তবে তার পেছনে রয়েছে শক্তিশালী ও স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা।
এই প্রস্তাব প্রথম আসে কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় পার্টির মতো আওয়ামী মিত্রদের কাছ থেকে। এরপর জামায়াতে ইসলামী ও নবগঠিত ইসলামপন্থী দল জানাপা একে গ্রহণ করে। এর কারণ স্পষ্ট—এরা কেউই আসনভিত্তিক নির্বাচনে উল্লেখযোগ্যভাবে সফল হতে পারেনি। কিন্তু ভোট শতাংশের ভিত্তিতে হিসাব করলে সংসদে তারা বড় অংশীদার হয়ে উঠতে পারে। যেমন, ১৯৯৬ সালে জামায়াত ৮.৬১% ভোট পেয়েও মাত্র ৩টি আসনে জয়ী হয়েছিল। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালু থাকলে তখন তাদের ২৭টি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির সমর্থকেরা বলেন, এতে সংখ্যালঘু দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে, কর্তৃত্ববাদী শাসন ঠেকানো যাবে। কিন্তু বিশ্লেষণ বলছে, বাস্তবে এমন হয়নি। তুরস্ক, ইরান, রাশিয়ায় নিয়মিত নির্বাচন হয় এবং কোনো দেশে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিও আছে; কিন্তু কর্তৃত্ববাদ রোধ হয়নি। উপরন্তু, তুরস্কে পার্লামেন্ট এই পদ্ধতিতে গঠিত হলেও মূল ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে কেন্দ্রীভূত।
এছাড়া, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে সরাসরি জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ থাকে না। এতে জনপ্রতিনিধি নয়, দল নির্বাচিত হয়। দলীয় প্রধান যাদের মনোনয়ন দেবেন, তারাই এমপি হবেন—তাতে ভোটারদের কোনো হাত থাকে না। ফলে সংসদ সদস্যদের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব বাড়ে, জবাবদিহি কমে যায়।
বাংলাদেশে এখনো শক্তিশালী ও কার্যকর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। সবকিছু কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে যেসব জায়গায় সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালু, সেখানে প্রাদেশিক সরকার ও স্থানীয় পরিষদ অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা, পরিবহন সব নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় প্রশাসন। কেন্দ্রীয় সরকার কেবল নীতিনির্ধারণ করে।
বাংলাদেশে এই কাঠামো অনুপস্থিত থাকায় যদি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালু হয়, তাহলে রাষ্ট্রের ওপর একাধিক গোষ্ঠী বা দলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হতে পারে। সরকার জিম্মি হয়ে পড়তে পারে জোটসঙ্গী বা উগ্রবাদী শক্তির কাছে। এই পদ্ধতির সুযোগ নিয়ে ধর্মীয় গোষ্ঠীকেন্দ্রিকতা, উগ্র জাতীয়তাবাদ এমনকি বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে।
যদি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির মতো একটি গঠনগত পরিবর্তন চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে তা রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক ঝুঁকি হতে পারে। এতে দুর্বল জোট সরকার, সাংবিধানিক জটিলতা এবং গণতন্ত্রের পরিপন্থী রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি হয়। সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো, আওয়ামী লীগ তার পুরোনো নাম পাল্টে হলেও আবার সংসদে ঢুকে পড়তে পারে—নতুন শরিকদের মুখোশ পরে।
অথচ এই দলেরই অতীত অভিজ্ঞতা বলে, ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে ভোট শতাংশের হিসেবে বিএনপির কাছাকাছি থেকেও আসন কম পেয়ে সরকার গঠন করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। তখন কিন্তু তারা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির জন্য চাপ দেয়নি। এখন যখন নিজেদের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন, তখন এ পদ্ধতির বিরতিহীন প্রচার শুরু হয়েছে—তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে যেখানে এখনও রাজনৈতিক শিক্ষা, স্থানীয় শাসন ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ দুর্বল; সেখানে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালু করলে তা দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা সংকট ও অস্থিরতার উৎস হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই মুহূর্তে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালুর প্রশ্নটা কেবল একটি নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কারের প্রস্তাব নয়, বরং এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক ব্যর্থতা ঢাকার একটি উপায়, যেটি দেশের ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
আপনার মতামত জানানঃ