বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই দেশের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা কম হলেও তা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড্যান স্মিথ বলেন, ‘পারমাণবিক হামলা চালানো বোকামি হবে, তবে অসম্ভব নয়।‘
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। শনিবার (১০ মে) ভোরে পাকিস্তান দাবি করেছে, তারা ভারতের একাধিক সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। তার আগে ভারতের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র পাকিস্তানের তিনটি ঘাঁটিতে আঘাত হেনেছে বলেও ইসলামাবাদ অভিযোগ করেছে। এ পরিস্থিতি দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের আশঙ্কা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই দেশের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা কম হলেও তা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড্যান স্মিথ বলেন, ‘পারমাণবিক হামলা চালানো বোকামি হবে, তবে অসম্ভব নয়।‘
ভারত ১৯৭৪ সালে প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা চালায় এবং ১৯৯৮ সালে দ্বিতীয় দফায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমানে ভারতের হাতে রয়েছে প্রায় ১৮০টি ওয়ারহেড। এর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, মোবাইল লঞ্চার, এবং রাশিয়ার সহায়তায় নির্মীয়মাণ নৌ-মিসাইল।
পাকিস্তানও ১৯৯৮ সালে ছয়টি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পরমাণু শক্তির পরিচয় দেয়। চীনের কারিগরি সহায়তায় গড়ে তোলা পাকিস্তানের অস্ত্রভাণ্ডারে রয়েছে প্রায় ১৭০টি ওয়ারহেড, যার অধিকাংশই স্বল্প ও মধ্যপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। সেগুলো ভারতের অভ্যন্তরে আঘাত হানতে সক্ষম।
ভারতের পারমাণবিক নীতি
ভারতের একমাত্র আনুষ্ঠানিক পারমাণবিক নীতিমালা ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয়। এর চারটি প্রধান নীতি হল—
১। নো ফার্স্ট ইউজ (এনএফইউ): ভারত কখনো প্রথমে পারমাণবিক হামলা চালাবে না। শুধুমাত্র আক্রমণের জবাবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে।
২। বিশ্বাসযোগ্য ন্যূনতম প্রতিরোধ নীতি: ভারতের পারমাণবিক অবস্থান মূলত প্রতিরোধমূলক। অর্থাৎ, এর পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার মূলত অন্য দেশগুলোকে পারমাণবিক হামলা চালানো থেকে বিরত রাখার জন্যই রাখা হয়েছে। এই কারণেই ভারত এখনো পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি এনপিটিতে স্বাক্ষর করেনি। নয়াদিল্লির যুক্তি—সব দেশ যদি একযোগে নিরস্ত্রীকরণে না যায়, তবে শুধু ভারতকে নিরস্ত্র হওয়ার দাবি করা ন্যায্য নয়।
৩। ভয়াবহ প্রতিশোধ: কোনো প্রতিপক্ষ যদি প্রথমে পারমাণবিক হামলা চালায়, তবে ভারত তার জবাবে পাল্টা আঘাত হানবে যা শত্রুর সামরিক সক্ষমতা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে—এমনটাই ভারতের পারমাণবিক নীতিতে বলা হয়েছে। এই জবাব হবে অত্যন্ত বিধ্বংসী এবং লক্ষ্য হবে শত্রু পক্ষের যুদ্ধ চালানোর ক্ষমতা একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।
৪। জৈব বা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার হলে ব্যতিক্রম: ভারতের ‘নো ফার্স্ট ইউজ’ নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম হলো—যদি কোনো রাষ্ট্র ভারতকে বা বিদেশে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাদের লক্ষ্য করে জৈব বা রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করে, তবে ভারত সেই অবস্থায় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের অধিকার সংরক্ষণ করে। অর্থাৎ, ভারত সাধারণত প্রথমে পারমাণবিক হামলা চালায় না। তবে এই ধরনের অস্ত্রের আক্রমণের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নয়।
ভারতের এই পারমাণবিক এই নীতিমালা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে অপরিবর্তিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতীয় রাজনীতিকরা এর নমনীয়তা নিয়ে মন্তব্য করেছেন। বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ২০১৯ সালে বলেছিলেন, ‘পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে নীতির পরিবর্তন হতে পারে।‘
পাকিস্তানের পারমাণবিক নীতি
পাকিস্তান তার পরমাণু নীতিতে কৌশলগত অস্পষ্টতা বজায় রেখেছে। এর ফলে তারা যে কোনো পর্যায়ে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে এমন ইঙ্গিত রয়েছে। বিশেষ করে, ভারতের তুলনামূলক শক্তিশালী সামরিক অবস্থানের মোকাবেলায় এ ইঙ্গিত তাৎপর্যপূর্ণ।
পাকিস্তানের পারমাণবিক নীতির সঙ্গে যুক্ত একজন গুরুত্বপূর্ণ কৌশলবিদ হিসেবে বিবেচিত এবং পারমাণবিক কমান্ড সংস্থার একজন উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল খালিদ কিদওয়াই ২০০১ সালে চারটি ‘রেড লাইন’ নির্ধারণ করেন, যেগুলো লঙ্ঘিত হলে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা তৈরি হয়—
১। স্থানিক সীমারেখা: পাকিস্তান একটি বড় অংশের ভূখণ্ড হারালে তা পারমাণবিক প্রতিক্রিয়ার কারণ হতে পারে। এই বিষয়টিই মূলত ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
২। সামরিক সীমারেখা: পাকিস্তানের স্থল বা আকাশবাহিনীর একটি বড় অংশ ধ্বংস হলে বা লক্ষ্যে পরিণত হলে তা পারমাণবিক প্রতিক্রিয়ার সম্ভাব্য সূচক হতে পারে।
৩। অর্থনৈতিক সীমারেখা: আগ্রাসী পক্ষের এমন কোনো পদক্ষেপ যা পাকিস্তানের অর্থনীতির পথ রুদ্ধ করতে পারে।
৪। রাজনৈতিক সীমারেখা: এমন কোনো পদক্ষেপ যা পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে বা অভ্যন্তরীণভাবে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ঘটায়।
তবে, পাকিস্তান কখনোই স্পষ্ট করে বলেনি ঠিক কতটা ভূখণ্ড বা কত বড় আকারের সামরিক ক্ষতি হলে এই প্রতিক্রিয়াগুলি সক্রিয় হবে। পাকিস্তান বিগত কয়েক বছরে তাদের অস্পষ্ট নীতির অবস্থান থেকে সরে এসে প্রকাশ্যভাবে ‘নো ফার্স্ট ইউজ (এনএফইউ)’-এর বিপরীত অবস্থান নিয়েছে। ২০২৪ সালের মে মাসে এক সেমিনারে পাকিস্তানের পারমাণবিক কমান্ড সংস্থার উপদেষ্টা খালিদ কিদওয়াই স্পষ্টভাবে বলেন, ইসলামাবাদ নো ফার্স্ট ইউজ নীতি মেনে চলে না।
উল্লেখযোগ্যভাবে, ২০১১ সাল থেকে পাকিস্তান তথাকথিত কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র (ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার ওয়েপনস বা টিএনডব্লিউ) তৈরি শুরু করেছে। এই অস্ত্রগুলো স্বল্প-পাল্লার পারমাণবিক বোমা, যেগুলোর লক্ষ্য থাকে যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু বাহিনীর ওপর সীমিত পরিসরে আঘাত হানা; যাতে বিস্তৃত ধ্বংসযজ্ঞ না ঘটে।
২০১৫ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব আইয়াজ চৌধুরী স্বীকার করেন যে, ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে টিএনডব্লিউ ব্যবহার করা হতে পারে।
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, এই অস্ত্রগুলোর বিস্ফোরণ ক্ষমতাও বিপজ্জনকভাবে বেশি হতে পারে। এগুলোর বিস্ফোরণ শক্তি হিরোশিমা ধ্বংসকারী বোমার ২০ গুণ পর্যন্ত হতে পারে। এই ধরনের বিস্ফোরণ শুধু প্রতিপক্ষের ক্ষতিই নয়, পাকিস্তানের নিজস্ব সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোকেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ