নির্মম বাস্তবতা আর বিক্ষিপ্ত বার্তার মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠলো মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের আরেকটি রুদ্ধশ্বাস রাত। সোমবার রাত থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষ—যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ইরান ও ইসরায়েল একে অপরকে ঘায়েল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল—শেষ পর্যন্ত পৌঁছায় এক অনিশ্চিত যুদ্ধবিরতির দিকে। একদিকে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে কাতারের মার্কিন ঘাঁটিতে, অন্যদিকে ট্রাম্প ঘোষণা করেন যুদ্ধবিরতির, যদিও তাতে ছিল না ইরানের নিশ্চিত সায়। পুরো ঘটনাপ্রবাহ যেন কূটনীতির নাট্যমঞ্চে রচিত এক বিভ্রান্তিময় উপাখ্যান।
সবকিছু শুরু হয়েছিল আরও আগে—১৩ জুন, যখন ইসরায়েল ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামে ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাগুলোতে আকস্মিক হামলা চালায়। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তখন দাবি করেন, ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে বোমা তৈরির পর্যায়ে নিয়ে যেতে চলেছে, এবং তাই সময়ের আগেই এটিকে থামাতে হবে। ইরান, প্রত্যাশিতভাবেই, পাল্টা জবাবে ‘ট্রু প্রমিস’ নামের এক অভিযানে শত শত রকেট ও ড্রোন ছুঁড়ে দেয় ইসরায়েলের দিকে। এক মুহূর্তে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য, যেন দ্বিতীয় লেবানন যুদ্ধের ছায়া ফিরে এসেছে, তবে আরও বিস্তৃত মাত্রায়।
এরপর ঘটলো সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা—যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ‘সম্পূর্ণ ধ্বংসাত্মক’ হামলা, যার দায় স্বীকার করেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শনিবার রাতে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনাকে লক্ষ্য করে চালানো এই হামলার জেরে সোমবার রাতে ইরান পাল্টা আঘাত হানে কাতারের মার্কিন ঘাঁটি আল উদেইদে, যেটি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন বাহিনীর সবচেয়ে বড় ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত।
তবে ইরানের এই হামলায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি, কারণ ঘাঁটিটি পূর্ব প্রস্তুতির অংশ হিসেবে খালি করে ফেলা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও এই হামলা বিশ্ববাসীর মধ্যে উদ্বেগের ঢেউ তোলে, বিশেষ করে যখন দোহা শহরের আকাশে বিকট শব্দ ও আলোয় ভেসে ওঠে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় হওয়ার দৃশ্য।
এই উত্তেজনার মধ্যেই আসে এক নাটকীয় ঘোষণা—ডোনাল্ড ট্রাম্প এক্স হ্যান্ডেলে (Truth Social) পোস্ট করে জানান, ইসরায়েল ও ইরান একটি “সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক” যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে, যা কার্যকর হবে ছয় ঘণ্টার মধ্যে। যদিও ইসরায়েল এই ঘোষণা নিয়ে কোন মন্তব্য করেনি, আর ইরানের পক্ষ থেকে বিষয়টিকে প্রথমে “একটি দাবি” হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ আব্বাস আরাঘচি জানান, যদি ইসরায়েল স্থানীয় সময় ভোর চারটার পর আর কোনো আগ্রাসন না চালায়, তাহলে ইরানও আর জবাব দেবে না। অর্থাৎ, যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা শর্তসাপেক্ষ। কিন্তু ঠিক এই সময়েই ইরানের রেভোলিউশনারি গার্ডসের ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যম ফার্স নিউজ দাবি করে, ট্রাম্পের ঘোষণা সম্পূর্ণ মিথ্যা, এবং তারা কোনো আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবই পায়নি।
এদিকে কাতারের ভূমিকাও সামনে আসে। মার্কিন ও মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম জানায়, যুদ্ধবিরতির সমঝোতায় কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান আল থানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। দোহায় মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের হামলার পর কাতার ইরানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে যুদ্ধ থামানোর বার্তা পৌঁছায়।
এই মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্র যেন নতুন করে আঁকা হচ্ছে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলছে, কাতারে প্রায় ৮ হাজার মার্কিন নাগরিক অবস্থান করছে। সেখানে কিছু ব্রিটিশ সেনাও অবস্থান করছে রোটেশনের ভিত্তিতে। আল উদেইদ ঘাঁটি হলো মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের আঞ্চলিক সদর দফতর, যেখান থেকে পুরো অঞ্চলের সামরিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
যুদ্ধবিরতির এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম কমতে শুরু করে, যা নির্দেশ করে বিশ্ববাজারও একরকম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—এই যুদ্ধবিরতি কতটা স্থায়ী হবে? ট্রাম্প বলেছেন, ২৪ ঘণ্টা পূর্ণ হলে এই যুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যকার দীর্ঘদিনের অবিশ্বাস আর বিদ্বেষ কী এত সহজেই থেমে যাবে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ তার ‘ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া’ হুমকির পর একেবারে ১৮০ ডিগ্রি ঘূর্ণন, যা তার পররাষ্ট্রনীতির তাৎক্ষণিকতাকে প্রকাশ করে। একদিন তিনি শাসনব্যবস্থা বদলের কথা বলেন, আর পরদিন শান্তির বার্তা দেন। ফলে ইরান, ইসরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র—তিন পক্ষের মধ্যে এখন এক ধরনের দ্বিধা ও কৌশলগত দ্বন্দ্ব কাজ করছে।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু এখন আর শুধু অস্ত্র আর বোমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটি হয়ে উঠেছে তথ্য, প্রচার, এবং কূটনীতির এক বিস্ময়কর খেলা। ট্রাম্পের সামাজিকমাধ্যমে ঘোষণার আগে এমনকি পরও কোনো পক্ষই সরাসরি একে স্বীকৃতি দেয়নি। কারণ সবাই জানে—মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিরতি মানে হলো, পরবর্তী লড়াইয়ের আগাম প্রস্তুতি।
এই যুদ্ধ একদিকে ইরানের জন্য ছিল আত্মরক্ষার, অন্যদিকে ইসরায়েলের জন্য ছিল সম্ভাব্য পারমাণবিক হুমকি ঠেকানোর চেষ্টা। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র? তাদের অবস্থান ছিল দ্বিধাগ্রস্ত—একদিকে তারা ইরানকে পরমাণু কর্মসূচির কারণে শাস্তি দিতে চায়, আবার একই সময়ে অঞ্চলে সামরিক উত্তেজনা বাড়ুক তাও চায় না। এই দোদুল্যমান অবস্থানই ট্রাম্পের বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে।
সব মিলিয়ে, ১২ দিনের এই যুদ্ধ শেষ হতে চলেছে এক রহস্যঘেরা শান্তির মাধ্যমে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, ইরান-ইসরায়েল বিরোধ কখনোই স্থায়ীভাবে মিটে যায় না—তবে কিছু সময়ের জন্য বিরতি নিতে পারে। সেই বিরতির পর যখন আবার বোমা পড়বে, তখন হয়তো আবার এক নতুন ‘ট্রুথ পোস্ট’-এ দেখা যাবে শান্তির ডাক, আর বিশ্বের মানুষ আবারও তাকিয়ে থাকবে মধ্যরাতের খবরের দিকে, অপেক্ষায়—শুরু হলো না তো আবার?
আপনার মতামত জানানঃ