বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত, রক্তাক্ত এবং রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি রচিত হলো ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে। এটি ছিল এক গণআন্দোলনের সময়কাল—ছাত্র-যুবকদের নেতৃত্বে সূচিত এক আন্দোলন, যা দীর্ঘ ১৫ বছরের একচ্ছত্র শাসনের অবসান ঘটায়। আর এই আন্দোলনের জবাবে সরকার যে ভয়াবহ রকমের দমন-পীড়নের আশ্রয় নেয়, সেটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও আলোড়ন তোলে। এই পটভূমিতে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ গঠনের ঘটনা দেশ ও বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো কেবল রাজনৈতিক নয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মারাত্মক উদাহরণ হিসেবেই বিশ্ব বিবেকের সামনে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের হিসাবে ২০২৪ সালের ১লা জুলাই থেকে ১৫ই আগস্টের মধ্যে বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ১৪০০ মানুষ নিহত হয়—যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু। এই হতাহতের ঘটনায় সরাসরি যুক্ত থাকার অভিযোগেই শেখ হাসিনা, তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন মন্ত্রী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা গঠিত হয়েছে। প্রসিকিউটরদের বক্তব্য অনুসারে, এটি ছিল একটি “সমন্বিত, বিস্তৃত এবং পর্যায়ক্রমিক হামলা”, যার নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও তার ঘনিষ্ঠ মহল।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতে স্বেচ্ছা নির্বাসনে রয়েছেন। যদিও তিনি এই মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করে প্রত্যাখ্যান করেছেন, তবে ট্রাইব্যুনালের অভিযোগপত্রে তার বিরুদ্ধে পাঁচটি গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে: গণহত্যায় প্ররোচনা, উস্কানি, সহযোগিতা, ষড়যন্ত্র এবং গণহত্যা রোধে ব্যর্থতা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে যে প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়েছে, তা আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে—যার মধ্যে রয়েছে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর ভিডিও ফুটেজ, ড্রোন থেকে তোলা ছবি, মোবাইল কথোপকথনের রেকর্ড এবং ভিকটিমদের সাক্ষ্য।
রোববার, এই বিচারিক কার্যক্রম সরাসরি বাংলাদেশ টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়—যা দেশের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, এই বিচার প্রতিশোধ নয় বরং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। তিনি বলেন, “গণতান্ত্রিক সমাজে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের কোনো স্থান নেই।”
শেখ হাসিনার সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন দায়িত্বে থাকা আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে। মামুন বর্তমানে নিরাপত্তা হেফাজতে থাকলেও কামাল পলাতক রয়েছেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, আদালতে হাজির না থেকেও তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
এই মামলার পটভূমি তৈরি হয়েছিল রংপুরে, ১৬ই জুলাই ছাত্রনেতা আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ড দিয়ে। পুলিশের গুলিতে ঘনিষ্ঠ দূরত্ব থেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি নিহত হন। আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে তাকে গণমাধ্যম বারবার স্মরণ করেছে এবং এই হত্যাকাণ্ডই যেন সারাদেশে প্রতিরোধের আগুন ছড়িয়ে দেয়।
৫ই আগস্টের ঘটনার ভিত্তিতে পুলিশের আট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। তাদের মধ্যে চারজন বর্তমানে হেফাজতে থাকলেও বাকিদের অনুপস্থিতিতেই বিচার চলছে। ওই দিনই শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করেন এবং ভারতে পালিয়ে যান।
রাজনৈতিকভাবে এই বিচার একটি বড় রূপকথার মতো মনে হলেও এর বাস্তবতা আরও জটিল। কারণ, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার নিজেই যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই একই আইসিটি আজ তাকে এবং তার ঘনিষ্ঠ মহলকে বিচারের মুখোমুখি করেছে। অথচ তখনকার বিচারগুলো ছিল পাকিস্তানপন্থি যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে, যেগুলোকে অনেকেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখেছিলেন। এবার ইতিহাস যেন নিজেই উল্টো পথে হেঁটে এসেছে—নির্মাতাই এখন বিচারের আসামি।
এদিকে এই বিচারিক কার্যক্রম বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও বড় পরিবর্তন এনেছে। জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক নিবন্ধন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। শেখ হাসিনা তার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং এর নেতাকর্মীদের ওপর দমন চালিয়েছিলেন। এখন সেই জামায়াত আবার নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার ফিরে পেয়েছে। পাশাপাশি মে মাসে অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যে এক বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই বিচার নানা প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। ফ্রান্সের বার্তা সংস্থা এএফপি, কাতারের আল জাজিরা, ভারতের ক্রল, যুক্তরাষ্ট্রের হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং সংবাদমাধ্যম বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। অনেকেই বলছেন, এটি কেবল একটি রাজনৈতিক নেতার বিচারের ঘটনা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতার জন্য এক পরীক্ষা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এই বিচার কার্যক্রম সত্যিই পক্ষপাতহীন ও স্বচ্ছ হয়, তাহলে তা হবে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি উদাহরণ। তবে যদি এটি পরিণত হয় আরেকটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ক্ষেত্র হিসেবে, তাহলে তা নতুন করে সহিংসতা ও বিভক্তির জন্ম দিতে পারে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা করেছে, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যেই তারা দেশকে একটি স্থিতিশীল পথে ফেরত আনতে চায়। তবে সেটি কতটা সম্ভব হবে, তা অনেকাংশেই নির্ভর করছে শেখ হাসিনার বিচারিক কার্যক্রম, আন্দোলনের স্বরূপ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সহাবস্থানের ওপর।
এই বিচার কেবল এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, এটি যেন এক দীর্ঘ সময় ধরে চলা ক্ষমতার দম্ভ, দমন-পীড়ন ও জবাবদিহিহীনতার বিরুদ্ধে দেশের গণমানুষের এক প্রতিরোধ। এবং সে প্রতিরোধের ফলাফল কী দাঁড়াবে—তা নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের আগামী ইতিহাস।
আপনার মতামত জানানঃ