মানব সভ্যতার ইতিহাসে ‘পৃথিবী’ বলতে আমরা যা বুঝি, তা একটাই—সূর্যকে কেন্দ্র করে একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান একটি গ্রহ। কিন্তু আপনি যদি জানতে পারেন, ভবিষ্যতে পৃথিবী তার এই চিরচেনা কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়তে পারে, তাহলে কেমন লাগবে? শুনতে এটি যেন কোনো সায়েন্স ফিকশন সিনেমার প্লট। কিন্তু বাস্তবে এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। অন্তত বিজ্ঞানীরা এখন সেটাই বলছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্ল্যানেটারি সায়েন্স ইনস্টিটিউট এবং ফ্রান্সের বোর্ডো বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক, ন্যাথান এ কাইব এবং শন এন রেমন্ড, একটি যৌথ গবেষণায় এমন এক অস্বাভাবিক সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন যা অনেকের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। তাঁদের গবেষণার মূল ভিত্তি ছিল কম্পিউটার সিমুলেশন, যেখানে ভবিষ্যতে সৌরজগতে বিভিন্ন নক্ষত্রীয় প্রভাবের ফলে কী কী পরিবর্তন ঘটতে পারে তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
এই সিমুলেশন অনুযায়ী, আগামী চারশো বছরের মধ্যেই আমাদের সৌরজগতে এমন এক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে, যা পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহের কক্ষপথে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। এটি হতে পারে কোনো ভ্রাম্যমাণ নক্ষত্রের আকস্মিক উপস্থিতির ফলে। এই নক্ষত্র সৌরজগতের কাছাকাছি চলে এলে তার মহাকর্ষীয় টানের ফলে পৃথিবী তার বর্তমান কক্ষপথ থেকে সরে যেতে পারে।
অবশ্য এই সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ—মাত্র ০.২ শতাংশ। তবে মহাকাশীয় অস্থিতিশীলতার কথা বললে, এমন একটি সম্ভাবনাও বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে উপেক্ষণীয় নয়।
সৌরজগতের গ্রহগুলোর কক্ষপথ সাধারণত নির্ধারিত এবং স্থিতিশীল। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই কক্ষপথগুলো আসলে আপেক্ষিকভাবে স্থিতিশীল। একটি ভারসাম্য বজায় থাকলেও তা ক্ষণিকেই ভেঙে পড়তে পারে যদি কোনো বাহ্যিক প্রভাব কাজ করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর কক্ষপথ তুলনামূলকভাবে কম স্থিতিশীল। অন্যদিকে, বৃহস্পতি ও শনির মতো গ্যাস-জায়ান্ট গ্রহগুলো অনেক বেশি মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ধারণ করে। তাই বৃহস্পতির মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর গতি ও কক্ষপথে হঠাৎ করে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে, বিশেষ করে যদি অন্য কোনো নক্ষত্র এসে এই ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করে।
গবেষকরা মনে করছেন, যদি এমন কোনো নক্ষত্র সৌরজগতের ভেতরে ঢুকে পড়ে বা কাছ দিয়ে অতিক্রম করে, তাহলে বুধের কক্ষপথে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আসতে পারে। বুধের কক্ষপথে এমন এক পরিবর্তন পৃথিবীর জন্য ভয়াবহ হতে পারে—শুক্র বা মঙ্গল গ্রহ পৃথিবীর দিকে ধাবিত হতে পারে। এমনকি পৃথিবী সূর্যের খুব কাছাকাছি চলে গিয়েও ধাক্কা খেতে পারে।
তাদের ভাষায়, “এই ধরণের ঘটনা সাধারণত বিলিয়ন বছর সময়কালে ঘটে থাকে, তবে এটি যে ঘটবেই না, এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।”
যদি পৃথিবী সত্যি সত্যি তার কক্ষপথ থেকে বেরিয়ে যায় এবং সৌরজগত ছাড়িয়ে যায়, তাহলে তার ফলাফল হতে পারে ভয়াবহ:
সূর্যের তাপ ও আলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে পৃথিবীতে জীবন যতটা নির্ভরশীল অক্সিজেন, পানি বা খাদ্যের ওপর, তার থেকেও বেশি নির্ভর করে সূর্যের তাপে। সূর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুত হিমাঙ্কের নিচে নেমে যাবে।
সূর্যের অভাবে উদ্ভিদ থেকে শুরু করে প্রাণীকূল, কোনো জীবন টিকবে না। একমাত্র গভীর সমুদ্রের হাইড্রোথার্মাল ভেন্টসের পাশে থাকা কিছু প্রাণী হয়তো কিছু সময় টিকে থাকবে।
এক অবিশ্বাস্য কিন্তু সম্ভাব্য দৃশ্য হলো, পৃথিবী হয়তো অন্য কোনো নক্ষত্রের আকর্ষণে তার কক্ষপথে যুক্ত হয়ে যেতে পারে। তখন হয়তো একটি ‘নতুন সূর্য’কে কেন্দ্র করে পৃথিবী তার নতুন জীবন শুরু করবে।
এই প্রশ্নের উত্তর হলো—না, অন্তত এখনই নয়। যেহেতু এই সম্ভাবনার হার মাত্র ০.২ শতাংশ এবং সম্ভাব্য সময়কাল ভবিষ্যতের চারশো বছর পরের ঘটনা, তাই আমাদের এখনি চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। তবে এটি বিজ্ঞানের একটি বিস্ময়কর দৃষ্টিভঙ্গি, যা আমাদের সৌরজগত ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করে।
এই গবেষণায় মূলত মডেলিং ও কম্পিউটার সিমুলেশন ব্যবহার করা হয়েছে। বিভিন্ন সম্ভাব্য কক্ষপথ বিশ্লেষণ করে সিমুলেশনের মাধ্যমে দেখা হয়, কেমন পরিস্থিতিতে সৌরজগত অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। এতে কয়েক মিলিয়ন সম্ভাব্য ঘটনার মডেল তৈরি করা হয়। সেখান থেকেই ০.২ শতাংশ ঘটনাকে চিহ্নিত করা হয় যা পৃথিবীর কক্ষচ্যুতি ঘটাতে পারে।
এই গবেষণা একদিকে যেমন ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয়, অন্যদিকে তেমনই মানব সভ্যতার ক্ষণস্থায়ীতা ও মহাবিশ্বের বিশালত্ব আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আজকে যে সূর্য আমাদের আলো দেয়, তার অস্তিত্বও অনন্ত নয়। আর পৃথিবী? সেটিও মহাবিশ্বের এক ক্ষুদ্র কণামাত্র।
তবে বিজ্ঞানীরা যেমন বলছেন, “এই গবেষণা আমাদের ভয় দেখানোর জন্য নয়, বরং বোঝানোর জন্য যে আমাদের জগৎ কতটা পরিবর্তনশীল এবং প্রাকৃতিক নিয়মে কত অজানা ঘটনা অপেক্ষা করছে ভবিষ্যতে।”
আমাদের সৌরজগত আপাতত স্থিতিশীল। কিন্তু এই নিস্তব্ধ আকাশের মাঝে এক অদৃশ্য যুদ্ধ চলে—মাধ্যাকর্ষণ, কক্ষপথ, নক্ষত্রের গতি, আর সময়ের অজানা স্রোত। আমরা সে নাটকের এক ক্ষুদ্র চরিত্র মাত্র।
আপনার মতামত জানানঃ