ইরান, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক যুদ্ধবিন্যাস ও পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনাপ্রবাহ মধ্যপ্রাচ্যকে নতুন করে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই সংঘাত এমন এক যুদ্ধ যা একদিকে যেমন সরাসরি সামরিক লড়াইয়ের ছবি এঁকেছে, অন্যদিকে তেমনি কূটনৈতিক হিসাব-নিকাশ, আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার ও বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্য নিয়েও গভীর প্রশ্ন তুলেছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে—এই সংঘাতে কে জিতেছে?
সম্প্রতি ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলার জবাবে ইরান তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর মার্কিন আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা আঘাত হানে। তবে এই আঘাত ছিল সীমিত এবং অত্যন্ত কৌশলগত। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি নিজে নির্দেশ দেন, যেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সর্বাত্মক যুদ্ধ এড়িয়ে চলা হয়। এক বাংকার থেকে দেওয়া তাঁর এই নির্দেশে বোঝা যায়, ইরান তাদের সম্মান রক্ষা করতে চাইলেও তারা বুঝে নিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়ালে দেশটির অস্তিত্ব ঝুঁকির মুখে পড়বে।
আক্রমণের লক্ষ্য ছিল কাতারের আল উদেইদ বিমানঘাঁটি, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি অবস্থিত। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী এই ঘাঁটিতে হামলা চালায়। কিন্তু আঘাত হানার আগেই কাতারকে সতর্ক করা হয়, আকাশসীমা বন্ধ করা হয়, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও আগাম বার্তা পায়। এর ফলাফল—মার্কিন কোনো নাগরিক নিহত হননি। ট্রাম্প নিজে জানান, ১৪টি মিসাইলের মধ্যে ১৩টি ভূপাতিত হয়, এবং এই হামলায় কোনো প্রাণহানি হয়নি। ফলে পাল্টা প্রতিক্রিয়া এড়ানো সম্ভব হয়েছে।
এই কৌশলগত হামলার মাধ্যমে ইরান আসলে একধরনের ‘পাওয়ার শো’ করেছে—একটি সীমিত এবং নিয়ন্ত্রিত পাল্টাঘাত। এর মাধ্যমে তারা তাদের নিজস্ব জনমনে একতা সৃষ্টি করেছে, দেশপ্রেমকে উস্কে দিয়েছে এবং আঞ্চলিক প্রতিপক্ষদের (বিশেষ করে ইসরায়েল) সতর্কবার্তা দিয়েছে যে, ইরান এখনও টিকে আছে, এবং সক্ষমতা হারায়নি।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলও নিজেদের বিজয়ের গল্প বলছে। যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে, তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পিছিয়ে দিতে পেরেছে। ইসরায়েল বলছে, তারা ইরানের সামরিক কাঠামোকে দুর্বল করে তুলেছে। কিন্তু ইরানও বলছে, তারা দাঁড়িয়ে আছে এবং এখনও জবাব দিতে সক্ষম।
আসলে এই ‘বিজয়ের দাবি’ একটা মনস্তাত্ত্বিক লড়াই—যেখানে প্রতিটি পক্ষ জনমত, আন্তর্জাতিক সমর্থন ও ভবিষ্যতের আলোচনায় অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি ইতিমধ্যেই তুরস্ক, রাশিয়া ও তুর্কমেনিস্তানে কূটনৈতিক সফর করেছেন। তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, যুদ্ধ ইরানকে ধ্বংস করতে পারেনি। অবশ্যই ক্ষতি হয়েছে, তবে তারা পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি। এটি একপ্রকার মনস্তাত্ত্বিক জয় বলেই ইরান তা উপস্থাপন করছে।
অবশ্য বাস্তবতা হলো, ইরান দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো অর্থনৈতিক বা সামরিক সক্ষমতা রাখে না। একদিকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, অন্যদিকে যুদ্ধজনিত ক্ষয়ক্ষতি ইতিমধ্যে দেশটিকে অর্থনৈতিক সংকটে ঠেলে দিয়েছে। দোকানপাট, পরিবহন, প্রশাসন সবই সীমিত হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী পেশাজীবী ও ট্যাক্সিচালকেরা বলছে—এই পরিস্থিতিতে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
এমনকি গার্ড বাহিনীর ঘনিষ্ঠ মহলও যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানাতে শুরু করেছে। বিশ্লেষক কারিম জাফারি বলছেন, ইরানের উচিত এখন বহুমুখী যুদ্ধ থেকে বিরত থাকা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতে না জড়ানো। এই সতর্কতা ইঙ্গিত করে, যুদ্ধ কেবল সামরিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, এটি রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সমাজের ভেতরে দ্বন্দ্বও তৈরি করছে।
যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনাও এখন দৃশ্যমান। ট্রাম্প নিজেই ইরানের ‘সতর্কবার্তা’ এবং ‘দায়িত্বশীল আচরণে’র প্রশংসা করেছেন। এমনকি ইরানকেও ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এটি কূটনৈতিকভাবে নজিরবিহীন এক ঘটনা। যুদ্ধের মাঝেই এমন সৌজন্য ইঙ্গিত করে, উভয় পক্ষই যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে।
তবে এই যুদ্ধ কি সত্যিই শেষ? বিশ্লেষকেরা বলছেন—এটি বরং এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। একদিকে ইরান হয়তো আবার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের পথে যাবে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল নির্ভর করছে গোয়েন্দা তথ্য ও গোপন নজরদারির ওপর। যুদ্ধ থেমেছে মানেই শত্রুতা শেষ হয়নি।
এই পুরো ঘটনা আমাদের শেখায়, আধুনিক বিশ্বে যুদ্ধ আর কেবল রণক্ষেত্রের সংঘর্ষ নয়—এটি কূটনৈতিক প্যাঁচ, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, মিডিয়ার প্রভাব ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের এক জটিল খেলা। এই খেলায় কে জিতল, সেটা হয়তো এককভাবে বলা কঠিন। কারণ, প্রত্যেকেই নিজেদের মতো করে ‘বিজয়’ দাবি করছে।
তবে একটি বিষয় পরিষ্কার—ইরান এখন আর আগের অবস্থানে নেই। তারা নিজেদের প্রতিরক্ষা ও কূটনৈতিক সক্ষমতা প্রমাণ করেছে, তবে একই সঙ্গে দুর্বলতাও প্রকাশ পেয়েছে। ইসরায়েল আঘাত করেছে, কিন্তু প্রতিক্রিয়াও পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সাময়িকভাবে সংঘাত নিয়ন্ত্রণ করেছে, তবে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা কমেনি।
এই মুহূর্তে যেকোনো ভুল সিদ্ধান্ত আবারও আগুনে ঘি ঢালতে পারে। শান্তির যে ক্ষীণ সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা যদি ধরে রাখা না যায়, তাহলে এই সংঘাত আবার রক্তাক্ত অধ্যায়ে রূপ নিতে পারে—এবং এবার হয়তো তা হবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অতএব, এখন সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার—যুদ্ধ না শান্তি? শক্তি প্রদর্শন, না কৌশলগত সমঝোতা?
বিশ্ব অপেক্ষায়। সময়ই বলবে, কে সত্যিকার অর্থে জিতেছে—যে হামলা করেছে, যে প্রতিশোধ নিয়েছে, না কি যে যুদ্ধ থামাতে পেরেছে।
আপনার মতামত জানানঃ