পৃথিবীর মানচিত্রে এমন কিছু দেশ আছে যাদের ইতিহাস, ভূগোল, রাজনৈতিক অবস্থান ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার একত্রিত হয়ে তাদের অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। ইরান সেই দেশগুলোর অন্যতম। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী পারস্য সভ্যতার উত্তরাধিকারী এই দেশটি একাধিক রাজবংশ, বিপ্লব, যুদ্ধ ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে গিয়ে নিজেকে এমন এক শক্তিতে পরিণত করেছে, যাকে সরাসরি পরাজিত করা ইতিহাসে কখনোই সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানের যে রাজনৈতিক ও সামরিক রূপান্তর ঘটেছে, তা একে এখন মধ্যপ্রাচ্যের এক পরাশক্তিতে পরিণত করেছে, যা ইসরায়েল ও আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত চাপে পড়ে থেকেও নিজেদের কৌশলগত লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি।
বর্তমানে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে এক ‘ছায়াযুদ্ধ’ ক্রমাগত বিস্তার লাভ করছে। এই যুদ্ধ কেবল গাজা, লেবানন কিংবা সিরিয়ায় নয়, বরং সাইবার জগত থেকে শুরু করে মহাকাশ, অর্থনীতি ও গ্লোবাল জ্বালানি রাজনীতিতেও চলছে। ২০২৩ সাল থেকে এই সংঘাত সরাসরি রূপ নিতে শুরু করে যখন ইসরায়েল ইরানের সিরিয়ায় থাকা কুদস বাহিনী ও হিজবুল্লাহ সমর্থিত ঘাঁটিগুলোতে বারবার হামলা চালায়। এরপর ২০২৪ সালের শেষ দিকে, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় ইরান সরাসরি একটি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায় ইসরায়েলের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায়—যা ছিল ইরান-ইসরায়েল ইতিহাসে সরাসরি প্রথম সামরিক সংঘর্ষ।
এই পাল্টাপাল্টি হামলা আন্তর্জাতিক সমাজকে চরম উদ্বিগ্ন করে তোলে, বিশেষত যখন ইরানের হামলায় ইসরায়েলের আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যূহ কিছু ক্ষেত্রে অকার্যকর প্রমাণিত হয়। এই সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীকে পারস্য উপসাগরে মোতায়েন করে ইরানকে হুমকি দিতে চায়। কিন্তু ইরান তার ‘অ্যাসিমেট্রিক ওয়ারফেয়ার’-এর মাধ্যমে বোঝায়, এই যুদ্ধ সহজ হবে না।
ইরানকে পরাজিত করা কেন এত কঠিন? প্রথমত, ইরানের ভূগোল একে প্রতিরক্ষা ও পাল্টা আক্রমণের এক অনন্য অবস্থানে রেখেছে। কাস্পিয়ান সাগর থেকে শুরু করে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত পর্বত, মরুভূমি ও উপত্যকায় ঘেরা দেশটি সামরিকভাবে বহিরাগতদের জন্য কঠিন এক চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত, দেশটির অভ্যন্তরে শক্তিশালী বিপ্লবী গার্ড বা ‘ইরানিয়ান রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (IRGC)’ রয়েছে, যারা কেবল সেনাবাহিনীর অংশ নয়, বরং একটি আদর্শিক সামরিক সংগঠন যারা আত্মত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ।
তৃতীয়ত, ইরান শুধুই একটি দেশ নয়, বরং এটি একটি মতাদর্শিক বলয়ের নেতৃত্বদানকারী। লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি, ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া ও সিরিয়ার বিভিন্ন সংগঠন—সব মিলিয়ে ইরান একটি “প্রক্সি আর্মি নেটওয়ার্ক” তৈরি করেছে, যা ইসরায়েল বা আমেরিকার জন্য সরাসরি যুদ্ধকে অত্যন্ত জটিল করে তোলে।
চতুর্থত, ইরান তেল ও গ্যাসে পরিপূর্ণ একটি ভূখণ্ড। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রমাণিত প্রাকৃতিক গ্যাস রিজার্ভ এবং বিশাল তেলের ভান্ডার রয়েছে এই দেশে। ফলে একে ধ্বংস করা মানে বিশ্ব জ্বালানি বাজারে বিপর্যয় সৃষ্টি করা—যা ইউরোপ, এশিয়া ও আমেরিকার অর্থনীতিকে একসাথে ধাক্কা দিতে পারে। এই কারণে পশ্চিমা বিশ্ব ইরানকে পুরোপুরি সামরিকভাবে ধ্বংস করতে চায় না, বরং ‘দমন ও নিয়ন্ত্রণে রাখার’ নীতি অনুসরণ করে।
গত ১৩ জুন, ইসরায়েল “অপারেশন রাইজিং লায়ন” নামে একটি অভিযানে ইরানের আরাক, নাতান্জ ও ফোর্ডোর পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আঘাত হানে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে আংশিক ক্ষতি হয়েছে এবং অন্তত ৬৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১২৭৭ জন। এছাড়া রাজধানী তেহরানে বড় আকারের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং বহু মানুষ শহর ত্যাগ করে।
ইরান অবশ্য চুপ করে থাকেনি। ১৯ জুন ইরান ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে সরাসরি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। Soroka Medical Center নামের একটি হাসপাতালে আঘাত লাগে, এতে অন্তত ৫০ জন আহত হন, যাদের মধ্যে ১৪ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এছাড়া টেল আবিবের আশেপাশে অন্তত ২৪ জন নিহত হন এবং ৫৯২ জনের বেশি মানুষ আহত হন। এই হামলা শুধু ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটি নয়, বেসামরিক স্থাপনাতেও আঘাত হানে, যা দুই দেশের মধ্যকার শত্রুতাকে এক ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে যায়।
যদিও একসময় বলা হতো যে ইরান ও ইসরায়েল ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে—ইরান হিজবুল্লাহ, হুথি ও সিরিয়ায় তার প্রভাব খাটাচ্ছে আর ইসরায়েল গোপনভাবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বিঘ্নিত করছে—তবে এখন সেই ধারণা বাস্তবতা থেকে বহু দূরে। যুদ্ধ এখন সরাসরি। ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো পরাশক্তিগুলোর ভূমিকা স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র পারস্য উপসাগরে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে, সাইবার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করেছে এবং ইসরায়েলের গোয়েন্দা ও বিমান প্রতিরক্ষা কার্যক্রমে সরাসরি সহায়তা দিচ্ছে।
এই পরিস্থিতি বিশ্ব অর্থনীতিতেও মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ইরানের বিরুদ্ধে হামলার পরপরই তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ১০ ডলার বেড়ে যায়। হরমুজ প্রণালী হয়ে জাহাজ চলাচলে ঝুঁকি দেখা দেয়, সুয়েজ খাল হয়ে পণ্য পরিবহন ধীরগতি হয়। এর ফলে ইউরোপ ও এশিয়ার দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে শুরু করেছে। খাদ্য, জ্বালানি ও পরিবহন ব্যয় হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এর প্রভাব শুধু মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না; এটি হয়ে উঠবে এক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দুর্যোগ। ট্রাম্প ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন যে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইরানে হামলা করবে কি না। আর যদি সেই সিদ্ধান্ত আসে, তাহলে এই যুদ্ধ এক বিশাল বৈশ্বিক সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে।
তবুও, ইরানকে পুরোপুরি পরাজিত করা এখনো অসম্ভব। এর পেছনে আছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। প্রথমত, ইরান কেবল একটি রাষ্ট্র নয়, এটি একটি মতাদর্শিক কাঠামো। ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এই রাষ্ট্রটি জনগণের মধ্যে আত্মত্যাগ ও প্রতিরোধের সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে, যা কেবল সামরিক শক্তির মাধ্যমে ভাঙা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, ইরানের ভূগোল—পাহাড়, মরুভূমি ও সীমান্তবর্তী পাহাড়ি অঞ্চল একে প্রতিরক্ষায় শক্তিশালী করেছে। তৃতীয়ত, ইরান তার শক্তিকে ছড়িয়ে দিয়েছে লেবানন, ইরাক, ইয়েমেন ও সিরিয়ার মতো দেশগুলোর ভেতরে, যেখানে তার ‘প্রক্সি আর্মি’ আছে। এই বাহিনিগুলো শুধু হামলার মাধ্যম নয়, বরং ইরানের কৌশলগত প্রতিরক্ষা।
এছাড়া, ইরানের নিজস্ব সামরিক শক্তিও এখন উন্নত। তাদের ড্রোন প্রযুক্তি, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও সাইবার হামলার দক্ষতা বিশ্বমানের। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতেই ইরান যে সাইবার হামলা চালায়, তাতে ইসরায়েলের পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ৪৮ ঘণ্টার জন্য অচল হয়ে যায়।
ইসরায়েল নিজেও ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ছে। মানবিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি দেশটির অর্থনীতি চাপে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা ইসরায়েল থেকে অর্থ তুলে নিচ্ছে, এবং দেশের ভেতর রাজনৈতিক বিভাজন বেড়েছে। দেশটির জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে গেছে, এবং অভ্যন্তরীণ প্রতিবাদ শুরু হয়েছে যুদ্ধের দীর্ঘায়নের কারণে।
এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো—যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই। দুই পক্ষই নিজেদের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় অটল। কূটনৈতিক আলোচনা চলছে ঠিকই, কিন্তু তা কার্যকর হওয়ার মতো পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি। আর বিশ্ববাসী তাকিয়ে আছে—এই যুদ্ধ কোথায় গিয়ে থামবে? না থামলেও, এর ঢেউ কতদূর ছড়িয়ে পড়বে?
ইতিহাস বলে, বহুবার ইরানকে থামানোর চেষ্টা করা হয়েছে। একবার ব্রিটিশরা, পরে আমেরিকা, এখন ইসরায়েল। কিন্তু প্রতিবারই ইরান শুধু টিকে গেছে নয়, বরং আরো শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছে। সুতরাং, ইরানকে সামরিকভাবে ধ্বংস করা যেতে পারে—এই ধারণা এখন অবাস্তব। বরং সেই চেষ্টাই আজ গোটা বিশ্বের ওপর চেপে বসেছে এক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও মানবিক সংকট হিসেবে।
এটাই প্রমাণ করে—ইরান অপরাজেয়। যতদিন না এই যুদ্ধের কারণগুলো রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা যাবে, ততদিন এই সংঘর্ষ চলবেই। আর এই চলমান যুদ্ধের খেসারত দিতে হবে কেবল ইসরায়েল বা ইরানকে নয়, বরং গোটা পৃথিবীকেই।
আপনার মতামত জানানঃ