কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উৎকোচ, অনিয়ম, অনৈতিক কার্যক্রম ও কারাবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা প্রায় ঘটছে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে। এদিকে করোনাকালে দেশের সব কারাগারে দর্শনার্থী প্রবেশে এক ধরনের বিধিনিষেধ রয়েছে। এরপরও জরুরি কোনো কারণে কোনো কারাবন্দির সঙ্গে কারাগারে তার স্বজনের সাক্ষাতের প্রয়োজন হলে কারা অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু অধিদপ্তরকে অবহিত না করেই গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার-১-এ একজন কয়েদির সঙ্গে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেছেন এক নারী। দেশের আর্থিক খাতের অন্যতম কেলেঙ্কারি হলমার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদের ভায়রা ও হলমার্কের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমদকে কারা কর্মকর্তাদের কক্ষে নারীসঙ্গের ব্যবস্থা করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
এ ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরইমধ্যে তিনজনকে প্রত্যাহার করে কারা অধিদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মো. মাইন উদ্দিন ভুইয়া তিনজনকে প্রত্যাহারের আদেশ দেন। প্রত্যাহারকৃত কর্মকর্তারা হলেন- কারাগারের ডেপুটি জেলার মোহাম্মদ সাকলাইন, সার্জেন্ট আব্দুল বারী ও সহকারী প্রধান কারারক্ষী খলিলুর রহমান।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মুমিনুর রহমান মামুন বলেন, প্রাথমিকভাবে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে তিন কর্মকর্তাকে কারা সদর দফতরে সংযুক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে তদন্তের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট যেকোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকেও দ্রুতই প্রত্যাহার করা হতে পারে।
কারাগারের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, ৬ জানুয়ারি বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ওই নারী কারাগারের ভেতর ঢোকেন। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বেরিয়ে যান। সিসি ক্যামেরায় পুরো সময়টা ধরা পড়েনি। এরমধ্যে রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। একটি অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে তিনি কারাফটকে আসার পর ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলাইন ও সিনিয়র জেল সুপার রত্না রায় ওই নারীকে অন্য কর্মচারীদের সামনেই গ্রহণ করেন। এর জন্য মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়েছে বলেও সূত্রটি জানিয়েছে। তুষার আহমেদের সঙ্গে অপরিচিত ওই নারী অন্তরঙ্গ ছাড়াও নানা ভঙ্গিতে বেশ কিছু সময় কাটান কারা ফটকের ভেতরে। এটা কীভাবে সম্ভব এমন প্রশ্ন সচেতন মহলের। এ ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরপরই কারা কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এছাড়া জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবুল কালামকে প্রধান করে পৃথক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন গত ১২ জানুয়ারি। ইতোমধ্যে সেই ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলাইন ও সার্জেন্ট প্রশিক্ষক আবদুল বারীসহ তিনজনকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।
তুষার আহমেদ এবং ওই নারীর সামনে থাকা সিনিয়র জেল সুপার রত্না রায়ের সঙ্গে পুরো বিষয়টি নিয়ে বারবার কথা বলার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তিনি মুখ খোলেননি। রত্না রায় বলেন, বিষয়টি নিয়ে যেহেতু উচ্চপর্যায়ের দুটি তদন্ত চলছে, সুতরাং এ মুহূর্তে তিনি এ সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন না।
৬ জানুয়ারির সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, কারাগারের ভেতরে কর্মকর্তাদের অফিস এলাকায় কালো রঙের জামা পরে ঘোরাফেরা করছেন তুষার আহমেদ। কিছু সময় পর বাইরে থেকে বেগুনি রঙের জামা পরা এক নারী সেখানে আসেন। এ সময় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার রত্না রায় ও ডেপুটি জেলার গোলাম সাকলায়েন সেখানে ছিলেন। দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে দুই যুবকের সঙ্গে ওই নারী কারাগারের কর্মকর্তাদের কক্ষের দিকে যান। সেখানে ওই নারীকে সাকলায়েন স্বাগত জানান।
ফুটেজে আরও দেখা যায়, ওই নারী কক্ষে ঢোকার পর সাকলায়েন বেরিয়ে যান। আনুমানিক ১০ মিনিট পর তুষারকে সেখানে নিয়ে যান সাকলায়েন। এর প্রায় ১০ মিনিট পর রত্না তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। দুই মিনিট পর রত্নার কক্ষের দিকে যান তুষার। এরও দুই মিনিট পর সেখান থেকে বেরিয়ে ওই নারীকে নিয়ে আবার রত্নার কক্ষে যান তুষার। যাওয়ার সময় তাদের হাসি-তামাশা করতে দেখা যায়। এর দুই মিনিট পর তুষার ও ওই নারী সাকলায়েনের কক্ষে ফেরেন। সেখান থেকে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর তারা বের হন।
ওই ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের গঠিত কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবুল কালামকে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উম্মে হাবিবা ফারজানা ও ওয়াসিউজ্জামান চৌধুরী।
এডিএম আবুল কালাম গতকাল শুক্রবার বলেন, প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য তাদের সাত কর্মদিবস সময় দেওয়া হয়েছে। দু–এক দিনের মধ্যে তারা প্রতিবেদন জমা দেবেন।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আজ শনিবার জানিয়েছেন, ‘কারাবন্দি অবস্থায় নারীসঙ্গের ঘটনা জঘন্যতম অপরাধ। কারাগারের ভেতরে এ ধরনের ঘটনাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। বিধি অনুযায়ী শাস্তি পাবে অভিযুক্তরা। যেই এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকবে, বিধি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের রাঘব বোয়ালদের প্রশ্রয় দেওয়া দেশের প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রায় সমস্ত প্রতিষ্ঠানেই একটা রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে। হোক সেটা আর্থিক বিনিময়ের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনো প্রভাবের কারণে। বিশেষ করে ভিআইপি কারাবন্দিদের সাথে কারা কর্মকর্তাদের এক গোপন সম্পর্ক তৈরী হয়। বন্দিদের সমস্ত সুযোগ সুবিধার দেখভাল করে থাকেন তারা। ফলে বন্দি বুঝতে পারেন না তিনি কারাগারে আছেন নাকি বাড়িতে। রাজকীয় সেবা শুশ্রুষায় তারা দিনাতিপাত করেন কারাগারের অসাধু এক শ্রেণির মাধ্যমে। তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে এসব বন্ধ হবে বলে মনে করেন না তারা। কেবল প্রত্যাহার কিংবা বদলি নয়, এরজন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৮
আপনার মতামত জানানঃ