‘চিলে কান নিয়ে গেছে’ বলে চিৎকার জুড়ে দিতে ব্যস্ত আমাদের গণমাধ্যমের কানে হাত দিয়ে সত্যতা যাচাইয়ের কোন চেষ্টাই থাকে না। আর এই প্রবণতার কারণে ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ এখন জনপ্রিয় আলাপ। প্রায় প্রতিদিন হয়ে যাচ্ছে মিডিয়া ট্রায়াল৷ অভিযুক্তকে অপরাধী বানিয়ে, প্রশ্নকর্তাকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে বিচার হয়ে যাচ্ছে মিডিয়ায়৷ হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে ব্যক্তিগত অধিকারে৷ যতক্ষণ পর্যন্ত আদালতে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি অভিযুক্ত৷ যত গুরুতর অপরাধের অভিযোগ থাকুক না কেন, তিনি অপরাধী নন৷
কিন্তু এই অভিযুক্ত ও অপরাধীদের মধ্যে যে অদৃশ্য রেখা আছে, সেটা এখন ক্রমশ মুছে যাচ্ছে৷ কতদিনে বিচার হবে, কবে তার রায় বেরোবে, সেই রায় কী হবে, সে সবের অপেক্ষা করার দরকার কী? হাতে যখন কলম বা মাইক আছে, তখন ইনস্ট্যান্ট বিচার হয়ে যাক৷ এই বিচার কখনও মিডিয়া করে, কখনও রাজনৈতিক দল, কখনও বা সামাজিক মাধ্যম অথবা প্রচুর মানুষের কোলাহল৷ শুরু হয়ে যায়, ফাঁসি দাও৷ অসম্মান করো; মানহানি করে দাও৷
আমাদের এই স্বভাবই এখন অস্ত্র হয়ে উঠেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পর এখন মাদক হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দাবার চাল। রাষ্ট্রীয় বাহিনী বা সোশ্যাল মিডিয়ায় যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে, বআসায় মদ পাওয়া যাচ্ছে; কিন্তু তারা এসব অপরাধ আদৌ করেছেন কিনা, নিশ্চিতভাবে জানার প্রয়োজনবোধ করছে না কেউ। সবার ধারণা অভিযোগ যেহেতু উঠেছে, সেহতু তারা অসামাজিক কার্যকলাপ, প্রতারণা, ব্ল্যাকমেইলিং করেও থাকতে পারেন। এই ধারণাই আমাদের নিয়ে যাচ্ছে বিচারহীনতার দ্বারপ্রান্তে।
আর এই ধারণার পালে হাওয়া দিচ্ছে গণমাধ্যম। সম্প্রতি সময়ে নায়িকা, মডেল ও ভুঁইফোড় রাজনীতিবিদদের ধরা হচ্ছে। কোনো একজন ভুক্তভোগী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর মামলা করার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কিন্তু ধরা হচ্ছে না। মজার ব্যাপার তাদের ধরা হচ্ছে যে অভিযোগের ভিত্তিতে, সেই অভিযোগেরই কোনো ভিত্তই নেই। দীর্ঘদিন ধরেই একই ফর্মেটে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বেশ কিছু অভিযান চালিয়েছে।
অদ্ভুত বিষয় অভিযানের ফলাফলও একই। অভিযানের পর অভিযুক্তদের বাসায় মদের বোতল পাওয়া যাচ্ছে। জানা যাচ্ছে, তারা ব্ল্যাকমেইলিংয়ের সাথে যুক্ত। আর এর সাথে যৌনতা বিষয়ক অভিযোগ যেন রেড ভেলভেট পেস্ট্রির উপরে চেরি। আমাদের ভদ্রস্থ সমাজ চোখ বুজে ঝাপিয়ে পড়ছে ট্রোল করতে, বিচার করতে। আর মিডিয়া জনগণের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মুখ হয়ে উঠেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই সব অভিযান চালাতে গিয়ে যা যা করছে মিডিয়া তা হুবহু প্রকাশ করছে। প্রশ্ন না করে, রিমান্ডে বেরিয়ে আসা সত্যের জামা পরা মিথ্যেকে রঙ লাগিয়ে বাড়িয়ে-চাড়িয়ে প্রকাশ করছে। অভিযুক্ত হয়ে উঠছে সমাজের চোখে অপরাধী। বিচারের আগেই বিচার করছে গণমাধ্যম। সত্য থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে মানুষকে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই সব অভিযান চালাতে গিয়ে যা যা করছে মিডিয়া তা হুবহু প্রকাশ করছে। প্রশ্ন না করে, রিমান্ডে বেরিয়ে আসা সত্যের জামা পরা মিথ্যেকে রঙ লাগিয়ে বাড়িয়ে-চাড়িয়ে প্রকাশ করছে। অভিযুক্ত হয়ে উঠছে সমাজের চোখে অপরাধী। বিচারের আগেই বিচার করছে গণমাধ্যম। সত্য থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে মানুষকে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মিডিয়ার মধ্যকার এই ঘনিষ্ঠতা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে টার্গেট করা মানুষদের উপর। অভিযুক্ত বললেই অপরাধী হয়ে যাচ্ছে মানুষ। মাদক আর মদের এই রাজনীতিতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে প্রকৃত বিচার ব্যবস্থা। সাধারণত নিরাপত্তাবাহিনী যখন কাউকে ‘অপরাধী’ তকমা দিয়ে অভিযান চালায় তখন মিডিয়া নিরাপত্তাবাহিনীর সে অভিযোগকে মোটামুটি সত্য বলে ধারণা তৈরি করে দিচ্ছে জনমানসের মনে। নৈতিকতার প্রশ্ন তুলে চুপ করিয়ে দেয়া হচ্ছে ভিন্নমতকে। আমাদের নৈতিকতাও বেশ হাস্যকর। দেশে লাইসেন্স থাকলে মদ কেনা, খাওয়া, রাখা বৈধ। অথচ বাসায় মদ পাওয়া গেলে সেটা অপরাধ। প্রমাণ না পাওয়া গেলেও এখানে অভিযোগই যথেষ্ট সম্মানহানির।
নাগরিক অধিকার কতভাবে ক্ষুণ্ণ হতে পারে যখন একটি দেশের প্রধান ধারার সংবাদমাধ্যম যদি সরকারি বাহিনীর সাথে হাত ধরাধরি করে চলে, তা আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকালে বোঝা যাবে। সম্প্রতি সময়ে যাকেই আটক করা হচ্ছে, তা যে অভিযোগেই হোক না কেন, তার বাড়ি থেকে উদ্ধার হচ্ছে মাদকদ্রব্য। প্রকৃত অর্থেই কি উদ্ধার করা হয়? তা জানার উপায় নেই। অন্তত গণমাধ্যমের এই প্রশ্নহীন লেজ নাড়ানো স্বভাবে সত্য উদঘাটনের কোন সম্ভাবনাই নেই এখন। এছাড়া গ্রেফতারের সময় শুধু মদ নয়, কারও কারও ক্ষেত্রে নারী ইস্যুও সামনে আনা হয়। এ যেন অভিযুক্তর সামাজিক অবস্থানের ভীত নাড়িয়ে দেয়া; প্রশ্নবিদ্ধ করা।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের এই দেশ প্রকৃত অর্থে না হলেও, দেখানোর জন্য দেশের মানুষের বড় অংশই ধর্মভীরু; ফলে কাউকে গ্রেফতারের সময় যদি মদ উদ্ধারের কথা বলা হয় বা যৌনতা বিষয়ক কোন অভিযোগ দেওয়া যায়, সেটি সামাজিকভাবে ওই ব্যক্তির প্রতি মানুষের ক্ষোভ তৈরিতে সহায়তা করে। তাকে সামাজিকভাবে অসম্মানিত করে। যাতে মানুষ তার আসল অপরাধটি আমলে না নেয়। কিংবা যাতে মানুষ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর আভিযানের আইনসম্মত ভিত্তি যাচাই না করে। বরং ওই অভিযুক্তের বাসায় মদ পাওয়া বা অন্যান্য অভিযোগ আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয় সমাজে। আর নাকের তলে রাষ্ট্রীয় বাহিনী স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে যাওয়ার লাইসেন্স পেয়ে যায়।
গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশের দায়িত্ব পালন করছে না; তার আর স্বাধীন নয়, তারাও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর একটি অঙ্গসংগঠন হিসেবে গড়ে উঠেছে। মানুষের জানার অধিকার এখন ফেব্রিকেটেড। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি গোষ্ঠী। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় অপরাধ না করেও যারা অভিযুক্ত হয়ে লাঞ্ছিত অপমানিত হন। তারা আদালতে ন্যায়বিচার পাওয়ার আগে জেল জরিমানার শিকার হয়ে যান। দোষী সাব্যস্ত হবার আগেই তারা সমাজের চোখে অপরাধী।
আর গণমাধ্যমের হাত ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই আইন লঙ্ঘনের যে সংস্কৃতি আমরা ট্রোল করে, সত্যের পক্ষে না দাঁড়িয়ে, চুপ করে থেকে গড়ে তুলছি, সেই সংস্কৃতির নিচে একদিন আমরা, আমাদের পরিবার চাপা পড়বে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬২৬
আপনার মতামত জানানঃ