গত ২৭ আগস্ট রাত ১০টার দিকে খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার বাসার উঠানের নলকূপে পানি আনতে যান রহিমা বেগম। কিন্তু এক ঘণ্টা পরও তিনি বাসায় না ফেরায় তার সন্তানেরা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। নলকূপের পাশে তাঁদের মায়ের জুতা, ওড়না ও পানির পাত্র পড়ে থাকলেও মাকে তাঁরা খুঁজে পাননি। এ ঘটনায় ওই রাতেই রহিমা বেগমের ছেলে দৌলতপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
পরদিন তার মেয়ে আদুরী আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা পরিচয়ের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে থানায় অপহরণ মামলা করেন। এ ছাড়া বিষয়টি র্যাবকেও জানানো হয়। এ মামলায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মায়ের সন্ধান চেয়ে ঢাকায় মানববন্ধনের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে দৌড়ঝাঁপ করে আসছেন সন্তানেরা।
এদিকে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বওলা গ্রামের ঝোপ থেকে উদ্ধার হওয়া লাশটি নিজের মায়ের বলে দাবি করেছেন মরিয়ম মান্নান। আজ শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে তিনি ফুলপুর থানায় যান। সেখানে লাশের পরিহিত কাপড় দেখেন। এরপর মরিয়ম দাবি করেন, লাশটি তার মায়ের। পরে মরিয়ম মান্নান ফুলপুর থানায় ডিএনএ পরীক্ষার আবেদন করেন।
ময়মনসিংহে ১৩ দিন আগে উদ্ধার করা বস্তাবন্দি লাশটি খুলনার দৌলতপুরের রহিমা বেগমের কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে ফুলপুরে পৌঁছেছেন তার চার মেয়ে।
ফুলপুর থানার ওসি আব্দুল্লাল আল মামুন জানান, শুক্রবার রহিমার লাশের সন্ধানে তার চার মেয়ে থানায় এসেছেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে রহিমা বেগমের মেয়ে মরিয়ম মান্নান ফেইসবুক পোস্টে মায়ের লাশ পাওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, “আমার মায়ের লাশ পেয়েছি এই মাত্র।”
তবে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই এবং পুলিশ বলেছে, লাশটি রহিমা বেগমের কি না নিশ্চিত নন তারা।
এ বিষয়ে মরিয়মের ভাই মো. সাদী বলেন, “লাশ পাওয়ার কথা আপার কাছে শুনেছি। মায়ের পরনের পোশাকের কয়েকটি ছবি দেখে লাশ পাওয়ার কথা জানিয়েছে আপা। এ নিয়ে আপা ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছেন, কান্নাকাটিও করছে।”
তবে কখন এবং কোথা থেকে লাশ উদ্ধার হয়েছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেনি সাদী।
ফুলপুর থেকে লাশ উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে পিবিআইয়ের খুলনার পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, গত ১০ সেপ্টেম্বর ফুলপুর থানা এলাকা থেকে এক নারীর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার হয়। ওই থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন আমাদের জানিয়েছেন, যে নারীর লাশ দাফন করা হয়েছে, তার বয়স ৩২। তার ডিএনএ নমুনা সংরক্ষণ করেছে পুলিশ।
ফুলপুরে যে নারীর লাশ পাওয়া গেছে তা মরিয়মের মায়ের কিনা নিশ্চিত নয় জানিয়ে এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “মরিয়মের মা রহিমা খাতুনের বয়স ৫৫ বছর। ফুলপুর থেকে উদ্ধার মৃত নারীর বয়সের সঙ্গে মরিয়মের মায়ের বয়সের ফারাক রয়েছে।
“যদি তার মেয়ে পোশাক দেখে লাশ শনাক্ত করেও থাকেন এরপরও ডিএনএ টেস্ট করে প্রকৃতভাবে লাশ শনাক্ত করতে হবে।“
“পরিবার এ নিয়ে কথা বললে আমরা পরবর্তীতে আগ্রসর হব।” যোগ করেন পিবিআইয়ের এ কর্মকর্তা।
আমি আমার মায়ের জামা কাপড় দেখে নিশ্চিত হয়েছি, এটা তারই লাশ।
এ বিষয়ে ফুলপুর থানার ওসি আব্দুল্লাল আল মামুন জানান, গত ১০ সেপ্টেম্বর ফুলপুর উপজেলার বওলা পূর্বপাড়া গ্রাম থেকে অজ্ঞাত নারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই নারীর ছবি ও তার পরনের থাকা পোশাকের ছবি ফেইসবুকে দেখে মরিয়মের মেয়েরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
তিনি বলেন, রহিমার লাশের খোঁজে শুক্রবার তার চার মেয়ে মরিয়ম মান্নান, কানিজ ফাতেমা, মাহফুজা আক্তার, আদুরী আক্তার থানায় এসেছেন। লাশ শনাক্তে সকাল থেকে পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করছেন তারা। কিন্তু তারা যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা দিয়ে লাশ শনাক্ত সম্ভব হচ্ছে না।
মরিয়মের মেয়েরা ফুলপুর থেকে উদ্ধার লাশের ডিএনএ পরীক্ষা করার আবেদন করেছে। এর জন্য নমুনা ঢাকায় সিআইডির কাছে পাঠানো হবে বলে জানান ওসি।
ফুলপুর থানায় মরিয়মের সঙ্গে কথা হয় সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের। লাশটি মায়ের কী করে নিশ্চিত হলেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি আমার মায়ের জামা কাপড় দেখে নিশ্চিত হয়েছি, এটা তারই লাশ।”
গত ২৭ আগস্ট রাত আনুমানিক ১০টার দিকে খুলনা মহানগরীর মহেশ্বরপাশার উত্তর বণিকপাড়ার নিজ বাসা থেকে টিউবওয়েলে পানি আনতে নিয়ে নিখোঁজ হন রহিমা বেগম। এরপর আর ঘরে ফেরেননি তিনি। স্বামী ও ভাড়াটিয়ারা নলকূপের পাশে ঝোপঝাড়ে তার ব্যবহৃত ওড়না, স্যান্ডেল ও বালতি দেখতে পান। সেই রাতে মাকে খুঁজতে আত্মীয়-স্বজন, সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ করেন সন্তানরা।
রহিমার ৬ সন্তান কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, কখনো মাইকিং করেন, কখনো আত্মীয়স্বজনদের দ্বারস্থ হয়েছেন। সংবাদ সম্মেলন করা হয়। মানববন্ধনের পর তাকে খুঁজে পেতে গত ১৪ সেপ্টেম্বর দৌলতপুর থানায় মামলা করা হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, পুলিশ ইচ্ছা করলেই সব পারে। এটা অনুমান নয়, বাস্তবতা। এমন বহু উদাহরণ দেশের পুলিশ বাহিনী রেখেছে। এমন অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনার কথা বলা যায়। নিদারাবাদ হত্যার অন্যতম আসামি তাজুলকেও রায়ের চার বছর পর কাকরাইল মসজিদ থেকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। কাজেই আমরা বিশ্বাস করতে চাই পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাইলে মরিয়ম মান্নানের মাকে উদ্ধার অথবা এ ঘটনার নেপথ্যে যারা তাদের আইনের আওতায় আনা কঠিন কাজ নয়। আমাদের প্রত্যাশা মায়ের জন্য আর কোনো মরিয়মকে যেন কাঁদতে না হয়
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির চারটি সুস্পষ্ট কারণ রয়েছে। এগুলো হলো-ক্রাইম ম্যাপিংয়ে ‘হট স্পট’ চিহ্নিত না করা; খুনি বা অপরাধীকে ভয় দেখানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, দুর্বল মামলা এবং তদন্ত রিপোর্ট ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাব। এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাবে শাস্তি এড়িয়ে যাওয়ার সংস্কৃতিও একটি বড় কারণ বলে মনে করা হয়। এ কারণে একদিকে যেমন অপরাধীদের গায়ে হাত দেওয়া যাচ্ছে না; অন্যদিকে গ্রেপ্তার হলেও তাদের আটকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
তারা বলেন, বলার অপেক্ষা রাখে না, নৃশংস হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য অপরাধের মাত্রা কমাতে হলে প্রথমে এর পেছনে থাকা কারণগুলো চিহ্নিত করে তা নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে। খুনসহ অন্যান্য অপরাধের ঘটনা যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে ধর্ষণ হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য সামাজিক অপরাধ কমে আসবে-এতে কোনো সন্দেহ নেই।
অবশ্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠাও জরুরি। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা অন্যতম শর্ত হলেও দুঃখজনক হলো, রাষ্ট্রে তার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। জাতীয় সংসদে কার্যকর কোনো বিরোধী দল নেই। সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে সরকারের ভুলক্রটিগুলো চিহ্নিত করার মতো কেউ থাকে না। তখন এর সুযোগ নিয়ে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
তারা মনে করেন, সারা দেশে ডাকাতি, ধর্ষণ, হত্যা-খুনসহ অন্যান্য অপরাধ ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির নিরসনকল্পে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, এটাই প্রত্যাশা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫১৩
আপনার মতামত জানানঃ