কিশোরগঞ্জের ভৈরবে র্যাব হেফাজতে সুরাইয়া খাতুন (৫২) নামে এক গৃহবধূর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। নিহত গৃহবধূ সুরাইয়া খাতুনের স্বামী আজিজুল ইসলামের অভিযোগ, আটকের পর নির্যাতন করে তার স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। তবে র্যাবের দাবি, আটকের পর সুরাইয়া হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
এদিকে ময়নাতদন্ত শেষে শনিবার দুপুরে নিহত গৃহবধূর লাশ ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার বরুনাকান্দা গ্রামে আনার পর মায়ের লাশ দেখা ও বিচার না হওয়া পর্যন্ত লাশ দাফনে বাধা দেয় তার দুই মেয়ে লিজা ও আফরোজা। নান্দাইল থানার ওসি মোহাম্মদ আবদুল মজিদ এবং স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন ভূঁইয়া সুষ্ঠু বিচারের আশ্বাস দিলে এক ঘণ্টা ১০ মিনিট পর বিকাল ৩টা ১০ মিনিটে লাশ দাফন করা হয়।
অন্যদিকে র্যাব হেফাজতে সুরাইয়া খাতুনের মৃত্যুর ঘটনায় ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. বুলবুল আহমেদ এর আবেদনের প্রেক্ষিতে ভৈরব থানায় শুক্রবার একটি অপমৃত্যু মামলা করা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে হাসপাতালে সুরাইয়া খাতুনকে মৃত অবস্থায় নিয়ে যান র্যাব সদস্যরা।
র্যাব হেফাজতে ওই নারীর মৃত্যুর পর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদের নির্দেশনায় জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইসরাত জাহান শুক্রবার রাতে ভৈরবে গিয়ে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। পরে শনিবার কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। সুরাইয়া খাতুন ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার চণ্ডিপাশা ইউনিয়নের বরুনাকান্দা গ্রামের আজিজুল ইসলামের স্ত্রী।
যৌতুকের দাবিতে অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূ রেখা আক্তারকে হত্যার অভিযোগে সুরাইয়া খাতুন, তার স্বামী আজিজুল ইসলাম এবং ছেলে তাইজুল ইসলাম লিমন এই তিনজনকে আসামি করে ময়মনসিংহের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রা্ইব্যুনালে গত ২রা মে মামলা করেন নিহত রেখার মা রমিছা বেগম।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই মামলার আসামি হিসেবে গত বৃহস্পতিবার রাতে নান্দাইল থানার গেইট থেকে সুরাইয়া খাতুনকে আটক করে র্যাব-১৪, সিপিসি-২, ভৈরব ক্যাম্প। এছাড়া তার ছেলে মামলার প্রধান আসামি তাইজুল ইসলাম লিমন (২৩) কে নারায়ণগঞ্জ থেকে একই রাতে আটক করে ভৈরব র্যাব ক্যাম্পে আনা হয়।
এরপর রাত পৌনে ১টার দিকে র্যাব-১৪ কিশোরগঞ্জ এর মিডিয়া হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এবং সংবাদকর্মীদের ইমেইলে বার্তা পাঠিয়ে জানানো হয়, শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় দুই আসামি গ্রেপ্তার ও হত্যাকাণ্ডের রহস্য বিষয়ে র্যাব-১৪, সিপিসি-২, ভৈরব ক্যাম্পে প্রেস ব্রিফিং করা হবে। কিন্তু এর আগেই সকাল ৭টায় আটক দুজনের মধ্যে সুরাইয়া খাতুন মারা গেলে সকাল ১০টা ১৩ মিনিটের দিকে পুনরায় বার্তা পাঠিয়ে প্রেস ব্রিফিংটি বাতিল করা হয়।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ঢাকার একটি বিস্কুট কারখানায় চাকরি করতেন সুরাইয়ার ছেলে তাইজুল ইসলাম লিমন। একই কারখানায় কাজ করতেন নান্দাইলের ভেলামারী গ্রামের হাসিম উদ্দিনের মেয়ে রেখা আক্তার (২০)। প্রেমের সম্পর্কের পরিণতি হিসেবে দেড় বছর আগে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে তাইজুল যৌতুকের জন্য রেখার উপর শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে আসছিল।
গত ২৬শে এপ্রিল রাতে অন্তঃসত্ত্বা রেখার উপর যৌতুকের জন্য নির্যাতন চালানো হয়। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় স্বামী তাইজুল ইসলাম লিমন, শ্বশুর আজিজুল ইসলাম ও শাশুড়ি সুরাইয়া খাতুন তাকে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ সময় তার স্বামী তাইজুল ও শাশুড়ি সুরাইয়া লাশ রেখে পালিয়ে যায়। হাসপাতালের কর্মচারীরা শ্বশুর আজিজুলকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন।
পরে পুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়। এরপর গত ২রা মে রেখার মা রমিছা বেগম ময়মনসিংহের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ি তিনজনকে অভিযুক্ত করে মামলা করেন। আদালতের নির্দেশে গত ১৩ই মে নান্দাইল থানায় মামলাটি রেকর্ড করা হয় এবং এসআই নাজমুল হাসানকে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়।
সুরাইয়ার স্বামী আজিজুল ইসলাম বলেন, আমাদের র্যাবের হাতে তুলে দিতেই এসআই নাজমুল হাসান থানায় ডেকে এনেছিল। আটকের পর র্যাবের নির্যাতন চালিয়ে আমার স্ত্রীকে হত্যা করেছে। আমি এ বিষয়ে আদালতে মামলা করব। আমি বিচার চাই। এদিকে শনিবার ময়নাতদন্ত শেষে সুরাইয়া খাতুনের লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। দুপুর দেড়টার দিকে তার লাশ বরুনাকান্দা গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সুরাইয়ার দুই কন্যা লিজা ও আফরোজার কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে এলাকার পরিবেশ।
বেলা দুইটায় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। নামাজে জানাজা শেষে মায়ের লাশ দেখা ও বিচার না হওয়া পর্যন্ত লাশ দাফনে বাধা দেয় তার দুই মেয়ে লিজা ও আফরোজা। নান্দাইল থানার ওসি মোহাম্মদ আবদুল মজিদ এবং স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন ভূঁইয়া সুষ্ঠু বিচারের আশ্বাস দিলে এক ঘন্টা ১০ মিনিট পর বিকাল ৩টা ১০ মিনিটে লাশ দাফন করা হয়।
এ বিষয়ে র্যাব-১৪ সিপিসি-২ কিশোরগঞ্জ ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার মো. আশরাফুল কবির বলেন, সকালে সুরাইয়া ভৈরব ক্যাম্পের ভেতর হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করেন। তাৎক্ষণিক তাকে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সম্ভবত হৃদরোগে তার মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ জানা যাবে।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইশরাত জাহান বলেন, র?্যাব হেফাজতে এক নারীর মৃত্যুর পর জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশে আমি মৃতদেহের প্রাথমিক সুরতহাল তৈরি করেছি। ইতোমধ্যে ওই নারীর ময়নাতদন্ত ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পর এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলা যাবে।
কিশোরগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. সাইফুল ইসলাম বলেন, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে র?্যাব হেফাজতে নারীর মৃত্যুর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এ সংক্রান্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বলা যাবে।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে র্যাব হেফাজতে মারা যাওয়া নারীর লাশের প্রাথমিক সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া এ ব্যাপারে সমস্ত আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে র্যাব-এর লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার আরাফাত ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, এখানে নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। তার প্রতি নির্যাতনও করা হয়নি। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার তিনি একজন আসামি ছিলেন। তাকে যখন র্যাব হেফাজতে নিয়ে আসা হয় তখন তিনি অসুস্থ বোধ করেন। তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
আপনার মতামত জানানঃ