নিয়ান্ডারথাল মানুষেরা কেমন ছিল. তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখালেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী স্ভান্তে প্যাবো।
অফিসের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে একটি ধূসর কঙ্কাল; যেন কে আসছে-কে যাচ্ছে তা পাহারায় রয়েছে এই ফসিল। ওর বাম হাতে ধরা রয়েছে একটি সাদা পার্টি বেলুন, কিন্তু ডানে নিচের বাহুটি উধাও।
“দুর্ভাগ্যবশত আমার ছেলে ওটা ভেঙে ফেলেছিল,” কঙ্কালের খুলিতে চাটি মেরে চাপা হেসে এ কথা বললেন স্ভান্তে প্যাবো।
জিন গবেষণার মাধ্যমে মানব বিবর্তনের অজানা অধ্যায়ে আলো ফেলা সুইডিশ বিজ্ঞানী স্ভান্তে প্যাবো চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ২০২২ সালে। ৪০ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত নিয়ানডার্থালদের জিন বিন্যাস উন্মোচন এবং বিশ্লেষণের প্রায় অসম্ভব কাজটি তিনি সম্ভব করেছেন। স্ভান্তে প্যাবোর অফিসের দরজায় প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা ওই কঙ্কালটি সেই নিয়ানডার্থাল।
ব্রিটিশ সংবাদপত্র গার্ডিয়ানের প্রতিবেদক যখন এই নোবেলজয়ীর সঙ্গে দেখা করেন, এই সুইডিশ বিজ্ঞানী তখনও তিনি গত অক্টোবরে মেডিসিন ও শরীরবিদ্যায় নোবেল ঘোষণায় নিজের নাম শোনার ধাক্কা সামলে ওঠার চেষ্টা করছেন। জিনতত্ত্ববিদ স্ভান্তে প্যাবোর সঙ্গে আলাপে নিয়ে জানুয়ারিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করে দ্য গার্ডিয়ান।
নোবেল প্রসঙ্গে স্ভান্তে প্যাবো অকপটে গার্ডিয়ানকে বলেন, “সত্যি বলতে, এই ঘটনা বেশ চাপের হয়ে উঠেছে। সবার নজর এখন আমার দিকেই দেখছি। তবে এসব চাপ আসলে উপভোগ্য।”
জার্মানির পূর্ব প্রান্তের শহর লাইপজিগ। ২৫ বছর আগে এখানে ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনস্টিটিউট ফর ইভোল্যুশনারি অ্যানথ্রোপলজি প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন স্ভান্তে প্যাবো। ভবনের প্রশস্ত লবিতে তিনি বেয়ে বেয়ে ওঠার দেওয়াল বসিয়েছেন; আর ছাদে করেছেন বাষ্প স্নানের ব্যবস্থা।
স্ভান্তে প্যাবোকে নোবেল জয়ের আনন্দ ভুলতে দেয়নি তার সহকর্মীরা। ”ওরা আমার জন্য পানীয় নিয়ে এল, তারপর সবাই মিলে আমাকে বাইরের পুকুরে ছুড়ে দিল; এখানকার প্রথা এসব। যদিও বেশ ঠান্ডা ছিল। আমার সহকর্মীরা অনেক উদারতাও দেখাল। ছুড়ে ফেলার আগে ওরা আমার চশমাটি খুলে নেয়, ফোন নিয়ে নেয়।”
সহকর্মীদের পক্ষ নিয়েই তিনি বলেন, “ওরা আসলে উচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছিল। এই নোবেল যতটা আমার ততটা তাদেরও তো। আর সত্যিই তো, এই বিষয়ে গবেষণায় প্রথমবার নোবেল জুটেছে।”
মানবজাতির ইতিহাস লেখার অসম্ভব কাজটি সম্ভব করার কৃতিত্বটুকু স্ভান্তে প্যাবোর ঝুলিতে এখন। প্রাচীন ডিএনএ মেলে ধরে তিনি বার করে এনেছেন নিয়ান্ডারথালের জিনোম সিকোয়েন্স। তিনি জীবাশ্মের জিন নিয়ে কাজ করে বিজ্ঞানের নতুন দিক খুলে দিয়েছেন।
হোমিনিন ও ডেনিসোভা প্রজাতি নিয়ে আগের অনেক ধারণা ভেঙে দিয়ে স্ভান্তে প্যাবোর গবেষণা বলছে, ৭০ হাজার বছর আগে নিয়ান্ডারথাল ও হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির জিনের মিলন ঘটেছিল।
স্ভান্তে প্যাবোর একাধিক তাক লাগানোর গবেষণার মধ্যে প্রথমটিতে তিনি দেখান, নিয়ান্ডারথাল ও আধুনিক মানুষের মধ্যে যতটুকু পার্থক্য, তা দুজন যে কোনো মানুষের মধ্যকার পার্থক্যের চেয়েও কম। নিয়ান্ডারথাল ও মানুষের মধ্যে অমিলের সংখ্যা ৩০ হাজারের মতো চিহ্নিত করা গেলে আজকের জীবিত মানুষের সঙ্গে অমিল ৩০ লাখ হবে।
তিনি বলেন, “ওই ৩০ হাজারের মধ্যে কোন পার্থক্যগুলো অতি জরুরি, তা খুঁজে বার করাই এখন আমাদের কাজ। কারণ এগুলোই বলে দেবে, মানুষ হিসেবে আমরা আলাদা কেন?”
এই বিজ্ঞানীর ধারণা, নিয়ান্ডারথাল জিনের অন্তত ৬০% থেকে ৭০% শতাংশ মিলবে জীবন্ত মানুষের শরীরে।
“যার মানে দাঁড়ায়, নিয়ান্ডারথাল আদতে বিলুপ্তই হয়নি, বরং মিশে গেছে আমাদের মধ্যে।” গবেষণার এই নেশা গোড়ার দিকে শখ ছিল স্ভান্তে প্যাবোর।
“শিশু বয়সে আমি প্রত্নতত্ত্ববিদ হতে চেয়েছিলাম, এবং মিশর বিশেষজ্ঞও। সুইডেনে আমি যেখানে থাকতাম সেখানে গোপনে নিজের জন্য গুহা খুঁড়েছিলাম।”
মায়ের সঙ্গে মিশর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা স্ভান্তে প্যাবোর জীবনে বড় রকমের ছাপ ফেলে; অবশেষে এর গুরুত্ব প্রমাণিতও হলো। ইজিপ্টোলজি নিয়ে পড়ার দিনে তার মনে হয়, ‘এর চেয়েও রোমান্টিক’ কিছু করার আছে তার। এরপরই তিনি মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন এবং পিএইচডি করেন আণবিক জীববিদ্যা নিয়ে।
“আমি বুঝতে পারলাম, এমন কিছু পদ্ধতি উদ্ভূত হয়েছে যা দিয়ে জীবের ডিএনএ দেখা যায়, ব্যাকটেরিয়ার বহু প্রজনন ঘটানো যায়, এরপর এসব বিশ্লেষণ করা যায়। আমি বুঝতে পারি মিশরীয় মমি দিয়ে এই নিরীক্ষা করে করে দেখার থেকে খুব বেশি দূরে নই আর।”
সাপ্তাহিক ছুটির দিকে গোপনেই নিরীক্ষা শুরু করে দিলেন স্ভান্তে প্যাবো। থিসিস পরামর্শকের সঙ্গে অবশ্য এসব কথা আলাপ করেননি তিনি; তার ভয় ছিল এসব হয়ত নির্বোধের উচ্চাকাঙ্ক্ষা মনে হবে। কিন্তু যখন ফলাফল হাতে এল, তার ভেতরে অসীম উৎসাহ ভর করল।
“প্রাচীন নমুনা থেকে ডিএনএ বার করে আনা সম্ভব হলেও, দেখা গেল অণুজীব ও ডিএনএর অন্যান্য উৎসসহ সবগুলো নমুনাই দূষিত হয়ে গিয়েছিল।”
নমুনা বিশ্লেষণে নতুন কোনো কার্যকর প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবতে বাধ্য হন স্ভান্তে প্যাবো। ভুল ও সংশোধন মিলিয়ে নিরীক্ষা করতে করতেই কেটে গেল কয়েক বছর; এভাবে এক সময় সম্ভব হলো নিয়ান্ডারথাল, ডেনিসোভান ও অন্য হোমিনিনের ডিএনএ আলাদা করা।
এই বৈজ্ঞানিক সাফল্যের পেছনে ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েনের গল্পও রয়েছে।
”আমার বাবা দুটি বিয়ে করেছিলেন। আমাদের কথা গোপনই রাখা ছিল। বাবার অন্য পরিবারের কথাই সমাজে জানত সবাই। শুধু শনিবার এলেই বাবাকে দেখা যেত। বাবা এলে কফি নয়ত দুপুরের খাবার খেতেন আমার ও মায়ের সঙ্গে। তারপর আবার উধাও হয়ে যেতেন।”
স্ভান্তে প্যাবোর মা কারিন ২০১৩ সালে মারা যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত অভিযানের সময় ১৯৪৪ সালে তিনি সুইডেন থেকে এস্তোনিয়া চলে যান। সেই সঙ্গে ভাষা ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে রসায়নবিদ হওয়ার স্বপ্নও ছিল তার চোখে।
বেঁচে থাকলে মা নিশ্চয়ই ‘গর্বিত ও উজ্জীবিত’ হতেন এই নোবল পুরস্কার প্রাপ্তির খবর জেনে; গার্ডিয়ানকে সে কথা বললেন স্ভান্তে প্যাবো। তার বাবা সুনে বার্গস্ত্রোম একজন জৈব রসায়নবিদ ১৯৮২ সালে শরীরে হরমোন জাতের প্রোস্টাগ্লান্ডিন উপাদানের প্রভাব গবেষণার জন্য নোবেল পেয়েছিলেন এই মেডিসিন ও ফিজিওলজি বিভাগেই। যদিও বাবার সেই গবেষণা স্ভান্তে প্যাবোর জীবনে বড় কোনো ভূমিকা রাখেনি।
“বরং মায়ের গবেষণার সুবাদেই বাবা ও মায়ের দেখা হয়েছিল। বিজ্ঞানে প্রতি মায়ের প্রবল টানই আমার ভেতরেও চলে এসেছে। মা আমার আগ্রহকে সায় দিতেন খুব। যখন আমি মেডিসিন থেকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে সরে আসি, তিনি আমাকে তখনও উৎসাহ দিয়েছেন। আসলে মা আমার জীবনে অনেক বড় অনুপ্রেরণা।”
স্টকহোমে বিজ্ঞানী বাবার নোবেল নেওয়ার অনুষ্ঠান টেলিভিশনে দেখেছিলেন স্ভান্তে প্যাবো। তখন তিনি উপসালা ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থী।
“আমার নামের পদবীতে বাবার সঙ্গে মিল ছিল না। গোটা কয়েক ছাড়া আর কেউ জানতও আমরা আমাদের সম্পর্ক নিয়ে,” বলেন তিনি।
সহকর্মীদের থেকে বিখ্যাত বাবার পরিচয় লুকিয়ে রাখা খুব বেশি কষ্টদায়ক ছিল না তার জন্য। তবে তার বাবার সামাজিক ভাবে স্বীকৃত সন্তান তাদের বিষয়ে কিছুই জানতেন না। এ নিয়ে বাবার সঙ্গে স্ভান্তে প্যাবোর দ্বন্দ্ব বেড়েই চলেছিল।
“আমি তো বাবাকে হুমকিও দিয়েছিলাম; তার ওই পরিবারকে খুঁজে বার করে সবকিছু জানিয়ে দেব। বাবা তখন বললেন, তিনি নিজেই সবকিছু খুলে বলবেন। যদিও সেই ক্ষণ আর আসেনি।”
২০০৫ সালে স্ভান্তে প্যাবোর বাবার মৃত্যুর দিনে সেই পরিবারের খোঁজ মেলে। একথা ২০১৪ সালে অবজারভারকে বলেছিলেন স্ভান্তে প্যাবো।
“আমার সৎ ভাই তখন জানতে পারে আমার কথা। সৌভাগ্যবশত তিনি মেনে নেন এবং আমরা ভালো ভাবেই মানিয়ে নিচ্ছি।”
একজন প্রত্নতত্ত্ববিদের সঙ্গে তুলনা করে স্ভান্তে প্যাবো মনে করেন, তার নিজের কৌতূহলই তাকে কাজের নির্দেশনা দিয়ে গেছে।
তিনি বলেন, “আমরা শুধু জিন খুঁড়ে চলেছিলাম।” স্ভান্তে প্যাবো ও তার গবেষক দল যে সব তথ্য উদঘাটন করেছেন তা বিবর্তন নিয়ে নতুন অধ্যায় সংযোজন করেছে।
“মানুষ হিসেবে কেন আমরা বিশেষ এবং বিবর্তন কীভাবে জীববিজ্ঞানকে প্রভাবিত করছে এসব নিয়ে বহুমাত্রিক সম্ভাবনার ক্ষেত্র হয়ে উঠবে এই গবেষণা,” বললেন তিনি।
আজকের মানুষের মধ্যে যারা নিয়ান্ডারথাল জিন বহন করছে কোভিডে তাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা দ্বিগুণ- গবেষণায় এই তথ্য উন্মোচিত হওয়া ভাবিয়ে তুলেছিল স্ভান্তে প্যাবোর গবেষক দলটিকেও।
”করোনাভাইরাসে মৃত্যুর পরিসংখ্যান ও ঝুঁকির ব্যাপকতা পর্যবেক্ষণ করে আমাদের ধারণা হলো, ১১ লাখ বাড়তি মৃত্যুর কারণ এই নিয়ান্ডারথাল জিন। এই ভ্যারিয়ান্ট দক্ষিণ এশিয়াতেই বেশি।”
মানুষের ব্যথার অনুভূতি নিয়েও আশ্চর্যজনক তথ্য দিচ্ছে স্ভান্তে প্যাবোর গবেষণা।
যুক্তরাজ্যের বায়োব্যাংকে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বায়োমেডিকেল ডেটাবেজ। এতে রয়েছে দেশটির প্রায় ৫ লাখ মানুষের জেনেটিক তথ্য। এই তথ্যভাণ্ডার কাজে লাগিয়ে স্ভান্তে প্যাবো দেখলেন, নিয়ান্ডারথাল ভ্যারিয়েন্ট বহনকারী মানুষের ব্যথা অনুভূতি প্রবল। ফলে তারা দ্রুত বুড়িয়ে যায়।
”নিয়ান্ডারথালরা নৃশংস ছিল, এমন ধারণা থেকে সরে নতুন করে ভাবতে হবে আমাদের। সম্ভবত তারা যথেষ্ট সংবেদনশীল ছিল।”
এইচআইভি প্রতিরোধক্ষমতা, প্রোজেস্টেরন হরমোনে উদ্দীপ্ত হওয়া, কিংবা এসবের প্রভাবে অপরিপক্ব নবজাতক ও গর্ভপাত হওয়াসহ আরও একাধিক বিষয় নিয়ে কাজ করছে স্ভান্তে প্যাবোর গবেষক দল। নিয়ান্ডারথাল জিনের অধিকারী কেউ গর্ভপাত এড়াতে পারবে এমন তথ্য গবেষণাও এসেছে।
“আজকের দিনে মানবগোষ্ঠীতে তিন রকমের উচ্চমানের নিয়ান্ডারথাল জিন দেখা যাচ্ছে। আমার ধারণা, আসলে এর চেয়েও বেশি রয়েছে,” বলেন স্ভান্তে প্যাবো।
৬৭ বছর বয়সের এই বিজ্ঞানী জানালেন, অবসর নেওয়ার সব পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত রেখেছেন তিনি। এখনও তার পরিপূর্ণ মনোযোগ কাজেই।
আপনার মতামত জানানঃ