মস্কোর নিউ আরবাট অ্যাভিনিউয়ে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ভিডিও স্ক্রীনগুলোর কয়েকটি সারিবদ্ধভাবে রাখা আছে। স্ক্রীনগুলোর সব ক’টিতে আজকে বড় একটি জ্বলন্ত মোমবাতির ছবি দেখানো হচ্ছে। সাথে একটি রুশ শব্দ দেখা যাচ্ছে, যার অর্থ “আমরা শোকাহত”।
ক্রোকাস সিটি হলে হামলায় নিহতদের জন্য শোক পালন করছে রাশিয়া। মৃতদের চূড়ান্ত সংখ্যা জানা যায়নি। কারণ এখনও মরদেহের সন্ধান চালানো হচ্ছে। সারা দেশেই রাশিয়ার পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। বিনোদন এবং ক্রীড়া অনুষ্ঠানগুলো বাতিল করা হয়েছে এবং টেলিভিশনের সংবাদ উপস্থাপকরা কালো পোশাক পরেছে।
মস্কোর ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত না হলেও সঙ্গীত পরিবেশনার ক্ষেত্রে ক্রোকাস সিটি হলটি ছিলো রাশিয়ার সুপরিচিত একটি স্থান। কিন্তু শুক্রবারের রক্তাক্ত হামলার ঘটনাটি এই কনসার্ট হলকে মুহূর্তেই নরকে পরিণত করেছে। হামলাকারীরা কেবল গুলি করেই হত্যা করেনি, আগুনে পুড়িয়েও মানুষ মেরেছে।
তারা ভবনটিতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সেটাকে রীতিমত একটি নরক বানিয়ে ফেলে। রাশিয়ার তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে, ভবনের ছাদ ধ্বসে পড়ছে। এমনকি ধাতব কড়িকাঠ গুলোও একইভাবে ধ্বসে পড়েছে।
ভবনের বাইরে এখনও পুলিশ সারিবদ্ধভাবে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে বিনোদন কমপ্লেক্সটির পুড়ে যাওয়া একটি অংশ দেখতে পাচ্ছি। বাইরের যে অবস্থা হয়েছে, সেটি দেখেই ভবনের ভিতরের ধ্বংসস্তূপের ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে নৃশংস হামলার ঘটনায় নিহতদের আত্মার প্রতি মানুষ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। সেই ফুলের স্তূপ ক্রমশ বড় হচ্ছে। গোলাপ ও কার্নেশন ফুলের পাশাপাশি তারা পুতুল ও অন্যান্য খেলনাও রেখে যাচ্ছেন। কারণ নিহতদের মধ্যে শিশুরাও রয়েছে। সাথে একটি বার্তাও ছেড়ে যাচ্ছে অনেকে। যেমন: আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্যে একজন বলেছেন: “তোমরা ইতর। আমরা তোমাদের কখনও ক্ষমা করবো না।”
মানুষের এই ভিড়ের মধ্যে বিষাদ ও ক্ষোভ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। “দেশ মাতৃকার হৃদয়ে ব্যথা করছে,” বলেছিলেন তাতিয়ানা। তিনি এখানে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কিছু ফুল নিয়ে এসেছেন।
“আমার আত্মা কাঁদছে। রাশিয়া কাঁদছে। এত অল্প বয়সী যুবকদের হত্যা করা হয়েছে। মনে হচ্ছে যেন আমার নিজের সন্তান মারা গেছে”, বলেন তাতিয়ানা।
এদিকে, হামলার সাথে জড়িত সন্দেহে চার ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। মস্কোর বাসমানি জেলা আদালত তাদেরকে দুই মাসের জন্য পুলিশি হেফাজতে থাকার নির্দেশ দিয়েছে।
মস্কো আদালতের আনুষ্ঠানিক টেলিগ্রাম চ্যানেলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। নামগুলো হচ্ছে: দালেরদজন মিরজোয়েভ, সাইদাক্রামি মুরোদালি রাচাবালিজোদা, শামসিদিন ফারিদুনি এবং মুহাম্মাদসোবির ফায়জভ।
মি. মিরজোয়েভ তার সব দোষ স্বীকার করে নিয়েছেন বলে জানা গেছে। তিনি মূলত তাজিকিস্তানের নাগরিক। ক্রোকাস সিটি হলে হামলা ও ব্যাপক গুলির ঘটনার দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠী। তাণ্ডব চালানোর পর হামলাকারীদের ছবিও প্রকাশ করেছে তারা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারাও বলেছেন যে, হামলার সাথে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠী জড়িত এবং এটি নিয়ে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু এখানে বেশ ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
রুশ কর্মকর্তারা এ ধারণা একটি কথা প্রচার করছেন যে, কোনো না কোনোভাবে ইউক্রেনই নৃশংস এই হামলার পেছনে রয়েছে।
শনিবার টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দাবি করেন যে, ইউক্রেনে পালানোর চেষ্টাকালে চার বন্দুকধারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি এটাও দাবি করেছেন যে, “সীমান্ত অতিক্রম করানোর উদ্দেশ্যে ইউক্রেন অংশে তাদের (হামলাকারীদের) জন্য একটি জায়গা প্রস্তুত রাখা হয়েছিল।”
কিয়েভ অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু তারপরও এটি ক্রেমলিনপন্থী পক্ষগুলোকে একথা বলা থেকে বিরত রাখতে পারেনি যে, হামলার সাথে ইউক্রেনের সংযোগ রয়েছে।
রাশিয়ার সরকারপন্থী সংবাদপত্র মস্কোভস্কি কমসোমোলেটস তাদের ওয়েবসাইটে ইউক্রেন বিরোধী একটি মতামতধর্মী লেখা প্রকাশ করেছে।
“ইউক্রেনকে অবশ্যই সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ঘোষণা করতে হবে” শিরোনামে প্রকাশিত লেখাটিতে উপসংহার টানা হয়েছে এভাবে: “কিয়েভ শাসনামলকে ধ্বংস করার সময় এসেছে…ওই দলের প্রত্যেককে অবশ্যই মরতে হবে। আর এই কাজ করার সামথ্যও রাশিয়ার রয়েছে।”
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এনেছে। ভয়াবহ এই হামলার প্রতিক্রিয়া ক্রেমলিন কীভাবে দেখাবে? মস্কোর ক্রোকাস সিটি হলে যে ঘটনা ঘটেছে, ইউক্রেনে সম্ভাব্য হামলা আরও বৃদ্ধি করার ন্যায্যতা আদায়ে রাশিয়ার নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিরা কি এটাকে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছেন?
আপনার মতামত জানানঃ