যুগের পরিবর্তন হয়েছে। সভ্যতা এসেছে কিন্তু অসভ্যতার ছাপ এখনও পুরোপুরি কাটেনি। একসময় ইউরোপ আর আমেরিকা ছিল দাস বাণিজ্যের রমরমা কেন্দ্র। আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে মানুষদের ধরে এনে ইউরোপ আমেরিকার বাজারে তাদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দিত অসাধু ব্যবসায়ীরা। আজও ইতিহাসের বিভিন্ন পরতে পরতে আর লেখকদের লেখনিতে পাওয়া যায় দাসপ্রথার সেই ভয়াবহ চিত্র।
মার্টিন লুথার কিং আমেরিকাকে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি দিলেও আরও অনেকদিন ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য আর চীনে টিকে ছিল এই প্রথা। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতেও যে গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের ধ্বজাধারী খোদ লন্ডনে জঘন্য এই প্রথার দেখা মিলবে তা হয়তো ভাবেননি অনেকে। কিন্তু এমনটাই ঘটেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে বিয়ে করে যুক্তরাজ্যে এনে পরিবারে দাসীর মত করে রাখা হচ্ছে অসংখ্য নারীকে। তাদেরকে নানান ভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে করা হয় মানসিক নির্যাতন।
এর মধ্যে রয়েছে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়ার ভয় দেখানো এবং পাসপোর্ট কেড়ে নেয়া। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদেরকে শারীরিক নির্যাতনও করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে বৃটিশ গণমাধ্যম বিবিসি একটি প্রতিবেদন বের করেছে।
বৃটেনে রোশনি নামের একটি চ্যারিটি সংগঠন গত এক বছরে এরকম প্রায় এক হাজার নারীকে সহায়তা দিয়েছে, যারা এরকম শারীরিক, যৌন এবং মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ভুক্তভোগী পাকিস্তানি এক নারীর নাম জোয়া দেশে একটি ডিগ্রি এবং ভাল চাকরি সহ একজন পেশাদার নারী ছিলেন।
কিন্তু বিয়ে করে এসে স্বামীর সংসারে বার্মিংহামে থাকা শুরু করলে তিনিও এরকম নির্যাতনের শিকার হন। বিয়ে করে তাকে দাসীর জীবন বরণ করতে হয়।
তিনি বিবিসি নিউজকে বলেছেন, শ্বশুর বাড়িতে আমাকে তালাবদ্ধ করে রাখা হত। তারা আমাকে ক্রীতদাস বলত। বলত, তুমি এখানে ঘর পরিষ্কার করতে এসেছ, আমি পালিয়ে গেলে পুলিশ আমাকে জেলে পাঠাবে।
আরেক নারী নায়লা বলেন, তাকে তার শ্বশুর শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। এরপর তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। পরিবারের লোকজন তাকে ভয় দেখিয়ে বলেছে, যদি সে পুলিশকে কিছু বলে তাহলে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানো হবে এবং তার বাচ্চাদেরকে সাথে নিয়ে যেতে দেয়া হবেনা।
চ্যারিটি সংগঠন রোশনি জানিয়েছে, সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত দুর্বলতাকে অপব্যবহার করে কৃষ্ণাঙ্গ এবং এশিয়ান এরকম অনেক নারীদের নিয়ন্ত্রণ এবং শোষণ করা হয়। উইমেনস এইড অনুসারে, ২০২২ সালে বৃটেনে ১.৭ মিলিয়ন নারী গার্হস্থ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নারী অধিকার দাতব্য সংস্থা দ্য ফসেট সোসাইটি জানিয়েছে, নারীরা ঘরোয়া সহিংসতা থেকে বাঁচার আগে গড়ে ১১ বার সাহায্য চান।
কিন্তু জাতিগত সংখ্যালঘু নারীদের জন্য এই সংখ্যা ১৭ গুণ বেড়েছে। তাদেরকে যারা দাসী বানিয়ে রেখেছে তারা বৃটেন থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দেয়। বাইরের কাউকে তাদের সমস্যার কথা জানালে বাচ্চাদের থেকে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করারও হুমকি দেয়া হয়। তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নেয়া হয়। ফলে প্রশাসনের কাছে তাদের আনুষ্ঠানিক অস্তিত্ব জানা থাকেনা।
চ্যারিটি সংগঠন রোশনি এ ধরনের শোষণকে আধুনিক দাসত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এরকম দাসী আমাদের শহর-নগরে বাসা-বাড়িতে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বসবাস করছে। বিবিসি এসব নারীর পরিচয় প্রকাশ করেনি। কারণ তারা এখনও ঝুঁকিতে রয়েছে।
রোশনি বলেছেন যে, এটি ওয়েস্ট মিডল্যান্ডস পুলিশ এবং এলাকার পুলিশ ও অপরাধ কমিশনারের (পিসিসি) সাথে তারা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে এবং পিসিসি বাজেট থেকে তহবিল পেয়েছে। তবে এরকম সমস্যার সমাধানের জন্য কাজ করতে গেলে বাজেট আরো বেশি প্রয়োজন।
আপনার মতামত জানানঃ