একসময় গবাদী পশুর মতোই হাটে-বাজারে কেনাবেচা হতো মানুষ। দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হতো তাদের। ঊনিশ শতকের শেষার্ধ্ব থেকে পুরো দুনিয়ায় দাস ব্যবসা বিলুপ্ত হতে শুরু করলেও, দাসপ্রথার ইতিহাস অতি প্রাচীন। এই বর্বর প্রথাকে উচ্ছেদ করার জন্য আন্দোলন-সংগ্রামও চলে এসেছে অনেকদিন ধরে। সেই আন্দোলন ও সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে, দুনিয়া থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্তি ঘটে দাসপ্রথার।
ইতিহাসে দাস ব্যবসায়ের প্রভাব অনেক। আর এই দাস ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল গুরুত্বপূর্ণ অনেক সংগঠনই। এই যেমন ১৮২১ সালে সাংবাদিক ও তুলা ব্যবসায়ী জন এডওয়ার্ড টেইলর ‘ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান’ নাম দিয়ে বর্তমান ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। টেইলরের এবং পত্রিকাটি চালু করার জন্য তাকে অর্থসহায়তাকারী ১১ জন ব্যবসায়ীর মধ্যে কমপক্ষে নয় জনেরই তুলা বাণিজ্যের সুবাদে দাসপ্রথার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল।
ট্রান্সআটলান্টিক দাসবাণিজ্যের সঙ্গে প্রতিষ্ঠাতাদের যুক্ত থাকার কারণে যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার মালিকপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করেছে। এছাড়া ক্ষতিপূরণ হিসেবে দশকব্যাপী বিভিন্ন প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছে। খবর দ্য গার্ডিয়ান-এর।
গার্ডিয়ান’র মালিক স্কট ট্রাস্ট জানিয়েছে, এটি ক্ষতিপূরণ প্রকল্পে ১২.৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করবে। এর মধ্যে ১৯ শতকে গার্ডিয়ান’র প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে সংযোগ থাকা দাসদের বর্তমান বংশধরদের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে কয়েক মিলিয়ন ডলার রাখা হয়েছে।
১৮২১ সালে সাংবাদিক ও তুলা ব্যবসায়ী জন এডওয়ার্ড টেইলর ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান নাম দিয়ে পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠা করেন। ওই সময় পত্রিকা প্রতিষ্ঠার জন্য জনপ্রতি ১০০ পাউন্ড দিয়ে টেইলরকে আর্থিকভাবে সাহায্য করেছিলেন ম্যানচেস্টারের আরও ১১ জন ব্যবসায়ী।
টেইলর ও অন্য প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দাসপ্রথার কোনো ঐতিহাসিক সম্পর্ক ছিল কি না তা জানতে ২০২০ সালে একটি স্বাধীন অ্যাকাডেমিক গবেষণা শুরু করা হয়।
মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) দ্য স্কট ট্রাস্ট লেগেসিস অভ এনস্লেভমেন্ট শিরোনামে ওই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা যায়, টেইলরের এবং তাকে অর্থসহায়তাকারী ১১ জনের মধ্যে কমপক্ষে নয় জনেরই টেক্সটাইল শিল্পের সুবাদে দাসপ্রথার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল।
ওকডেন অ্যান্ড টেইলর নামক তুলা উৎপাদন ফার্ম এবং শাটলওর্দ, টেইলর অ্যান্ড কো নামক তুলা বাণিজ্য কোম্পানির অংশীদার ছিলেন টেইলর। এ ফার্মের সুবাদে দাসবাণিজ্যের সঙ্গে তার একাধিক সংযোগ ছিল। এর মধ্যে দ্বিতীয় কোম্পানিটি আমেরিকায় দাসদের উৎপাদিত তুলা আমদানি করত।
এ প্রতিবেদন প্রকাশের পরপর গার্ডিয়ানের মালিক স্কট ট্রাস্ট ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় ও দাসদের বর্তমান বংশধরদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি গার্ডিয়ানের প্রথম দিকের সম্পাদকীয় অবস্থানের জন্যও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
স্কট ট্রাস্ট জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল, দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের খবর আরও বেশি প্রচার-প্রকাশ করবে গার্ডিয়ান। এ জন্য নতুন সম্পাদকীয় নীতিমালা করা হবে। এ ছাড়া ক্যারিয়ারের মধ্য পর্যায়ে থাকা কৃষ্ণাঙ্গ সাংবাদিকদের বৈশ্বিক ফেলাশিপ দেবে সংবাদমাধ্যমটি। গার্ডিয়ান ফাউন্ডেশনের আওতায় দেওয়া হবে প্রশিক্ষণ।
তিন ধাপে করা এ গবেষণায় নটিংহাম ও হাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলাইনা ও জর্জিয়ার উপকূলবর্তী সি আইল্যান্ডসের তৎকালীন তুলাখেতের সঙ্গে টেইলরের যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন। শাটলওর্দ, টেইলর অ্যান্ড কো-এর এক বিল থেকে জানা যায়, কোম্পানিটি ওই অঞ্চল থেকে তুলা আমদানি করেছিল। ওই বিলে তুলাখেতের মালিক ও দাস মালিকদের নাম ছিল।
এছাড়া গার্ডিয়ান’র প্রথমদিকের আরেকজন আর্থিক পৃষ্ঠপোষক, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ার বণিক স্যার জর্জ ফিলিপসও জ্যামাইকার হ্যানোভারে সাকসেস নামক একটি আখের আবাদের সহ-মালিক ছিলেন।
‘গবেষণায় চিহ্নিত আক্রান্ত সম্প্রদায়সমূহ এবং দাসদের বর্তমান বংশধরদের কাছে দুঃখ প্রকাশের’ পাশাপাশি স্কট ট্রাস্ট তুলা বাণিজ্য তথা দাসদের শোষণের সমর্থন দেওয়া গার্ডিয়ান’র প্রথমদিকের সম্পাদকীয় অবস্থানের জন্যও দুঃখ প্রকাশ করেছে।
আগামী এক দশক ধরে ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আমেরিকার গলা গিচি অঞ্চল ও জ্যামাইকায় বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করবে স্কট ট্রাস্ট।
এছাড়া গার্ডিয়ান জানিয়েছে এটি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের ওপর প্রতিবেদনের সংখ্যা বাড়াবে। এজন্য এটি ১২টি নতুন সাংবাদিকতার পদ তৈরি ও নতুন একটি সম্পাদকীয় কাঠামো সূচনার পরিকল্পনা করেছে।
ক্যারিয়ারের মাঝামাঝি থাকা কৃষ্ণাঙ্গ সাংবাদিকদের জন্য একটি বৈশ্বিক ফেলোশিপ তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে স্কট ট্রাস্টের।
গবেষণার তৃতীয় ধাপে গবেষকেরা গার্ডিয়ান’র প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে সম্পর্কিত কয়েকজন দাসের পরিচয় খুঁজে বের করার চেষ্টায় সফল হয়েছেন। এ সময় তারা ওসব দাসের জীবনের অনেক ঘটনার তথ্যও বিস্তারিতভাবে উদ্ঘাটন করতে সফল হন।
স্কট ট্রাস্টের চেয়ার ওলে জ্যাকব সান্ডের পাশাপাশি মঙ্গলবার গার্ডিয়ান নিউজ অ্যান্ড মিডিয়ার বর্তমান এডিটর-ইন-চিফ ক্যাথরিন ভাইনারও দুঃখপ্রকাশ করেছেন।
এছাড়া ‘কটন ক্যাপিটাল’ নামক একটি প্রতিবেদন সিরিজও চালু করেছে গার্ডিয়ান। এ সিরিজে বর্তমান গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলসমূহ নিয়মিতভাবে প্রকাশ এবং ট্রান্সআটলান্টিক দাসবাণিজ্য কীভাবে ম্যানচেস্টার, ব্রিটেন ও বিশ্বের অন্যান্য স্থানকে গড়ে তুলতে প্রত্যক্ষ্যভাবে সহায়তা করেছে তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।
এসডব্লিউএসএস/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ