ধর্মবিরোধী কাজকর্মের অভিযোগে পাকিস্তানে ফের মৃত্যুদণ্ড হল তিন ব্যক্তির। আরো একজনকে ১০ বছরের জেল দেওয়া হয়েছে। গত শুক্রবার(০৮ জানু) এই রায় দিয়েছেন পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অবস্থিত সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলো রানা নৌমান রাফাকত, আবদুল ওয়াহিদ ও নাসির আহমেদ। আর ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে আনোয়ার আহমেদ নামে একজন অধ্যাপকের, তাকে এক লক্ষ পাকিস্তানি রুপিও জরিমানা করা হয়েছে। মামলায় অন্য চার পলাতক আসামির জামিন-অযোগ্য স্থায়ী গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত।
পলাতক আসামিরা হলেন, তৈয়ব সরদার, রাও কায়সার শেহজাদ, ফরাজ পারভেজ এবং পারভেজ ইকবাল। যাদের বিরুদ্ধে আদালত অ-জামিনযোগ্য স্থায়ী গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। মামলার বাদী হয়ে হাফিজ মালিক মাজহার জাভেদ অ্যাডভোকেট, এফআইএর পক্ষে চৌধুরী মুহাম্মদ শফাকত অ্যাডভোকেট এবং আসামিদের পক্ষে আসাদ জামাল ও সৈয়দ হাসান আব্বাস অ্যাডভোকেট আদালতে হাজির হন।
দ্য ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এফআইএ) জানায়, ফাঁসির রায়ে দণ্ডিত রানা নওমেন রাফাকাত ও আব্দুল ওয়াহেদ ফেক প্রোফাইল তৈরি করে সামাজিক মাধ্যমে ধর্মীয় অবমাননাকর কনটেন্ট ছড়াতেন। এছাড়া নাসের আহমেদ ইউটিউবে এ ধরনের ভিডিও কনটেন্ট আপলোড করেছেন।
১০ বছর দণ্ডপ্রাপ্ত প্রফেসর আনোয়ার আহমেদ এর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি যখন ইসলামাবাদ মডেল কলেজের শিক্ষক ছিলেন তখন ধর্ম অবমাননা করে বক্তব্য রেখেছিলেন। তাকে এক লাখ রুপি জরিমানাও করা হয়।
অভিযুক্ত চারজনকেই ২০১৭ সালে প্রাথমিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়। একই বছরের ১৯ মার্চ এফআইআর দায়ের করা হয়। এফআইআর-এ বলা হয়, কতিপয় অজ্ঞাত ব্যক্তি/দল ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফেসবুক টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ওয়েবসাইটে অভিযুক্ত প্রোফাইল/ পেজ/ হ্যান্ডল/ সাইট.. ইত্যাদি থেকে ধর্মীয় অবমাননাকর কনটেন্ট বিতরণ করেছে/ ছড়াচ্ছে। আরও কয়েকজন স্বেচ্ছায় পবিত্র নাম নিয়ে অবমাননাকর শব্দ/ মন্তব্য/ গ্রাফিকস ডিজাইন/ ছবি/ স্কেচ/ ভিজুয়াল উপস্থাপনার মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করছে।
২০১৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর চার ব্যক্তিকেই এটিসি(সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আদালত) দোষী সাব্যস্ত করেন। সেসময় অবশ্য তারা আত্মসমর্থন করে জানিয়েছিলেন যে, তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগে তারা দোষী নন। এর আগে একই মামলায় প্রফেসর আনোয়ার আহমেদ এর জামিন আবেদন বাতিল করে দেন এটিসি।
তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে এই বিচারকার্য অব্যাহত থাকে। ডিসেম্বর মাসে মামলার রায়টি সংরক্ষণ করে নেওয়া হয়েছিল, যা গত শুক্রবার ঘোষণা করা হল।
এই মামলার বাদী ছিলেন হাফিজ এহতেশাম। মামলার বাদীর উকিল হাফিজ মালিক মাজহার জাভেদ অ্যাডভোকেট মামলার বিবরণে বলেন, ‘আসামিদের একজন নাসির আহমদ নবুওয়াত দাবি করেছিলেন। আর আসামি আবদুল ওয়াহেদ ও রানা এবং নোমান রাফাকাত জনৈক হিন্দু লেখকের বইয়ের অনুবাদ করেছিলেন, যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে ছিল। জুরআত-এ-তাহকিক নামে সামাজিক যোগাযোগের পেজে এটি আপলোড করা হয়। এই পৃষ্ঠাগুলিতে আরও অবমাননাকর বিষয়বস্তু আপলোড করা হয়েছিল।’
মামলার বাদী হাফিজ এহতেশাম গণমাধ্যমকে বলেন, “মামলাটি এফআইএ সাইবার ক্রাইম সার্কেল ইসলামাবাদে দায়ের করা হয় এবং এটি ধর্ম অবমাননা ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সংক্রান্ত প্রথম মামলা, যেখানে আসামিদের সাজা শোনানো হল।’
অন্যদিকে, আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা উচ্চ আদালতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন অথবা রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে পারবেন।
পাকিস্তানে ব্লাসফেমি বা ধর্ম অবমাননার অভিযোগ খুবই গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে দেশটিতে ব্লাসফেমি আইন চালু ছিল। ১৯৮০ সালে সামরিক শাসক জিয়াউল হক ক্ষমতায় এসে নবী মুহাম্মদ সা.কে অবমাননার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃতুদণ্ডের বিধান করেন। ১৯৮০ সাল থেকে ধর্ম অবমাননার দায়ে পাকিস্তানে ব্যক্তিগতভাবে বা উগ্র জনতা ৮০ জন মানুষকে হত্যা করেছে। ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই ব্লাসফেমি আইনের আওতায় দেশটিতে ১২৯৬টি মামলা দায়ের হয়েছে। দ্য ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডমের মতে, পাকিস্তানে ধর্মীয় অবমাননার দায়ে প্রায় ৮০ জন কারাবন্দি আছেন। তাদের অর্ধেকই যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলে আসছে পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের দমন করতে ধর্মীয় অবমাননা বিষয়ক আইনটি ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব অভিযোগের কারণে দাঙ্গা বা বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। পাকিস্তানের অধিকারকর্মীরা এই আইনের সমালোচনা করে বলেন, এই আইনটি পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু যেমন শিয়া ও আহমদিয়া (কাদিয়ানি) সম্প্রদায়ের অনুসারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়।তবে অধিকাংশ মানবধিকারকর্মী একমত প্রকাশ করেছেন যে, বিধর্মী এমনকি স্বধর্মীরাও এই আইনের শিকার হয়ে থাকেন। মূলত নিজেদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থেকে অনেকেই ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ তুলে সায়েস্তা করে। এসব ঘটনায় হত্যাকাণ্ডেরও বহু রেকর্ড রয়েছে। নিজেদের স্বার্থেই আইনটি বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে বলে মনে করেন মানবধিকারকর্মীরা।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ