টানটান উত্তেজনাপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচির পর পুলিশের অ্যাকশন, রাজপথে পুলিশ-বিএনপি’র সংঘর্ষ, বিএনপি’র দুজন শীর্ষ নেতাকে রাজপথে হেনস্থা ও পিটুনি অতঃপর প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ফুল পাঠানো, ডিবি প্রধানের রাজসিক মধ্যাহ্নভোজন- নতুন সব জল্পনার জন্ম দিয়েছে। তারমধ্যেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মাঠে আবার কর্মসূচি দিয়েছে। বোঝা যাচ্ছে রাজপথ সহসাই ছাড়ছে না উভয়পক্ষই।
এটা এখন বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সরকার আগের চাইতে কঠিন চাপে পড়েছে। একটা হচ্ছে অর্থনৈতিক চাপ। তার ডলার সংকট। এই সংকটে সামনে জ্বালানি খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রশ্নে আমেরিকা, ইউরোপের সহযোগে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক খারাপের দিকেই চলেছে।
সিনিয়র সাংবাদিক শুভ কিবরিয়া লিখেছেন, হিরো আলমের পক্ষে বিবৃতি দেয়া ১৩ জন ইউরোপীয় কূটনীতিককে তলব করেও যে সরকার স্বস্তি পেয়েছে তেমনটা বলা যাবে না। এরমধ্যে বিএনপিকে সমাবেশ করতে দিয়েছে সরকার। নানা উছিলায়, নানা বাধা সৃষ্টি করেও বিএনপি’র জনস্রোতকে জনসম্মুখে আসার সুযোগ দিতে হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে সরকার কী বাধ্য হচ্ছে, নাকি এটাও সরকারের একটা রণকৌশল।
এরই মধ্যে আবার নতুন করে ঝামেলা বাধিয়েছে আমেরিকার রিপাবলিকান দলের ১৪ জন কংগ্রেসম্যান। তারা সরাসরি জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ চাইছে বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ১৪ কংগ্রেসম্যান বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের আহ্বান জানিয়েছে।
কংগ্রেসম্যানরা জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ডকে লেখা চিঠিতে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন তত্ত্বাবধান ও পরিচালনার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশকে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ থেকে বহিষ্কার এবং শান্তিরক্ষা মিশনে র্যাবসহ মানবাধিকার হরণকারীদের নিষিদ্ধ করতে জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিন্ডা টমাস গ্রিনফিল্ডকে চিঠি দিয়েছেন এই ১৪ কংগ্রেসম্যান।
আরেকটা শঙ্কার কথা বলেছে আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিনিয়োগ ও পরিবেশবিষয়ক সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন। সেই প্রতিবেদনের মতে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে দেশের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
সরকার যেকোনো মূল্যে মাঠে থাকতে চাইছে। বিএনপি’র পায়ে পায়ে রাজপথে উপস্থিত থাকছে। সরকারের ভয় রাজপথে জনতার উপস্থিতি। সম্ভবত রাজনৈতিক সংগঠনের শক্তিতে সরকারের পূর্ণ আস্থা এখন সংশয়াপন্ন। বহু বছরের ক্ষমতার স্পর্শে থাকলে রাজনৈতিক সংগঠনের যেসব দুর্বলতা জেগে ওঠে আওয়ামী লীগ তার ব্যত্যয় নয়। এখনই মাঠে লোক আনতে তাদের ভয়ভীতি দেখাতে হচ্ছে বলে খবর রটছে। যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের ডাকা ২৮শে জুলাইয়ের শান্তি সমাবেশে যোগ দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে থাকা শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। ছাত্রলীগের হল পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ পত্রিকান্তরে জনগোচরে এসেছে।
সরকার জনগণকে দেখাতে চায় যে, বিএনপি’র নতির কাছে নত হওয়ার কোনো সুযোগ দিতে চায় না। এজন্য বিএনপি’র যেকোনো সমাবেশ বা রাজপথে রাজনৈতিক আয়োজনকে তারা বিনা চ্যালেঞ্জে ছাড় দেবে না, এটা এখন পরিষ্কার। পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে হয়তো পুলিশি অ্যাকশন আরও বাড়বে।
পরিস্থিতি যাই হোক সরকার বর্তমান সংবিধান মেনে তাদের অধীনেই নির্বাচন করতে চায়। এর জন্য ছলা-কলা- কৌশল যাই করা লাগুক না কেন, তারা সেই চেষ্টার কমতি করবে না। প্রয়োজনে নির্বাচন এগিয়ে আনলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কেননা, নির্বাচনের সময় যত পেছাবে, বিএনপি তত বেশি রাজনৈতিক স্পেস পাবে। সরকার সেই সুযোগ দিতে চাইবে না।
সেই হিসাব অনুযায়ী, সরকারের নির্বাচনী ছক সাজানোর বিষয়টি নজরে আসছে। ইতিমধ্যে নভেম্বরের মধ্যে দেশের সকল স্কুল-কলেজে পরীক্ষা শেষ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন নতুন নতুন দলকে নিবন্ধন দিয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে না এলে এসব ভুঁইফোড় নতুন দল, প্রয়োজনে বিএনপি’র বদলা হিসেবে মাঠে থেকে নির্বাচনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এমনকি জামায়াতকেও নির্বাচনী মাঠে নামাতে পারে সরকার। যদিও এই মডেল বহু পুরনো।
সরকার জেলা প্রশাসনে, জেলা পুলিশ প্রশাসনে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। এটাও সরকারের নির্বাচনী গেম-প্ল্যানের অংশ বলেই প্রতিভাত। নির্বাচনকে মাথায় রেখে জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার পদে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিব, আইনমন্ত্রীর পিএস, পানিসম্পদ উপমন্ত্রীর পিএস, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর পিএস, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়রের পিএস, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের পিএস, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর পিএস, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর পিএস নতুন জেলা প্রশাসক হয়েছেন। পুলিশের ক্ষেত্রেও তাই। বেছে বেছে দলীয় আনুগত্য নিশ্চিত হয় এমন লোকজনরাই এসব নিয়োগ পেয়েছেন। অপেক্ষাকৃত নবীন দলীয় আনুগত্য নিশ্চিত এসব কর্মকর্তাকে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হতে পারে, সরকারের বিবেচনায় সেটা থাকতে পারে।
সরকারের রাষ্ট্রনৈতিক কৌশল হচ্ছে রাষ্ট্রের শক্তি ব্যবহার করে বিরোধী দলকে মোকাবিলা করা। এক্ষেত্রে সামরিক- বেসামরিক আমলাতন্ত্রের একটা বড় অংশকে সরকার অতীতে ব্যবহার করেছে। এখনো সরকারের বড় ভরসা এই রাষ্ট্রশক্তি-পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
অন্যদিকে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের যে অংশ এতকাল দলীয় আনুগত্যের প্রকাশ রেখেছেন, দলীয়ভাবে চিহ্নিত সেই অংশের আওয়ামী লীগের পক্ষাবলম্বন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কেননা তারা জানেন, এতদিন তারা যা করেছেন, যেভাবে নিজ পেশায় চিহ্নিত হয়েছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে, তাদের পেশাজীবন বিপদাপন্ন হবেই। কাজেই নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হলেও তাদের আওয়ামী লীগের পক্ষাবলম্বন করা ছাড়া কোনো অপশন নেই। সরকার এই ভীতি আরও ছড়িয়ে, তাদের সামনের দিনে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করার কৌশল হাতছাড়া করবে না।
বাংলাদেশের জন্য আমেরিকার ভিসা নীতি অনেককেই নানাভাবে নতুন বিবেচনায় কাজ করার পথে ঠেলেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের ভবিষ্যতের সঙ্গে দেশের ব্যবসায়ী, আমলাতন্ত্রের যাদের ভবিষ্যৎ জড়িত তারা প্রয়োজনে সরকারের জন্য সর্বোচ্চ দেয়ার চেষ্টা করবে। এই ফোর্সকে ব্যবহার করেই সরকার বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের মাঠে নামতে পারে। শুধু তাই নয়, সরকার প্রয়োজনে কঠোর হস্তে বিরোধী আন্দোলন দমনের পথেই হাঁটতে পারে। সকালে পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে বিকালে ফুল পাঠিয়ে দুঃখপ্রকাশের মতন ঘটনা ঘটিয়ে হলেও বিরোধী দলকে রাজপথ ছাড়া করতে চাইবে। তখন রাজপথে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠতে পারে। যেটা আমেরিকান বিনিয়োগ প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
এটা মনে রাখা দরকার, সরকার পশ্চিমা বিশ্বের মনোযোগ কিছুটা হারালেও এখনো তলে তলে নানা নেগোশিয়েশন চালিয়ে যাচ্ছে। সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার বাংলাদেশে আসছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখাও করছেন। বাংলাদেশে পশ্চিমা বিশ্বের স্বার্থগত যে আগ্রহ সেটার একটা বড় ক্ষেত্র হচ্ছে আমাদের গভীর ও অগভীর সমুদ্রের খনিজ সম্পদ। সরকারের শেষ সময়ে এরকম একটা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুহূর্তেই গত ২৬শে জুলাই গভীর ও অগভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের লক্ষ্যে সরকার মডেল পিএসসি অনুমোদন করেছে। দেশের গভীর ও অগভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মডেল প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্টের (পিএসসি) খসড়া ‘ড্রাফট বাংলাদেশ অফশোর মডেল প্রডাকশন শেয়ারিং কনট্রাক্ট (পিএসসি) ২০২৩’ অনুমোদন দিয়েছে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভা। তড়িঘড়ি করে এই পিএসসি অনুমোদন বহুবিধ ইঙ্গিত দেয়। সরকার পশ্চিমাদের সঙ্গে এই মডেল পিএসসিকে রাজনৈতিক বার্গেনিংয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
এখন বিএনপি যদি ক্রমাগত রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে ঢাকার রাজপথ দখল করতেই থাকে, তাহলে কী হবে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও জানমালের নিরাপত্তার কথা বলে সরকার শক্তি প্রয়োগের কৌশলই নেবে। রাস্তায় গাড়ি পোড়ানোসহ নানাবিধ ঘটনার দায় চাপানো হতে পারে বিএনপি’র ওপর। তখন বিএনপি যদি হটে না যায়, মার খেয়েও রাজনৈতিক আন্দোলন সচল রাখতে পারে, তাহলে সরকারকেও নমনীয় হতে হবে। আবার সরকারের শক্তি প্রয়োগের ধারার বিপরীতে পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষত আমেরিকা কি প্রতিক্রিয়া দেয়, সেটাও খুব বড় ভূমিকা রাখবে।
এখন এটা পরিষ্কার, বহুবছর ক্ষমতায় থাকার পরও, একটা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে আবার ক্ষমতায় ফেরা, আওয়ামী লীগের জন্য সহজ নয়। অন্যদিকে বহু বছর ক্ষমতার বাইরে থেকেও, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন করে, ক্ষমতায় আসাও বিএনপি’র জন্য সহজ নয়। এই প্রায় দুই বিপরীত প্রান্তিক অবস্থানে চলে গেছে বাংলাদেশের রাজনীতি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারত, চীন, রাশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপীয় দেশসমূহের বহুমাত্রিক স্বার্থ ও কৌশল। ফলে, এখানকার রাজনীতি একইভাবে অতীতের মতো পুনরাবৃত্ত পথে ফিরবে- সেটা আশা করা যায় না। আবার জনআকাক্সক্ষার সঙ্গে তাল মিলিয়েই একটা পরিবর্তনের পথে যাবে এখানকার রাজনীতি, জনস্বার্থরক্ষাকারী সেই রাজনৈতিক পাটাতন এখনো বহু দূরের বিষয়।
এসডব্লিউএসএস১৫২০
আপনার মতামত জানানঃ