রাত নামলেই তৎপর হয়ে ওঠে কাঠ খেকোরা। শুরু হয় অবাধে কাঠ পাচার। একেতো শুস্ক মৌসুম, তার উপর প্রচণ্ড কুয়াশা ও শীতের তীব্রতায় স্থানীয়রা সন্ধ্যার পরপরই ঘরে কাঁথায় মুডিয়ে যায়। এ সুযোগে বন উজাড় করে সাবাড় করে দিচ্ছে বনখেকোরা। প্রতিদিন রাত ১২টার পর থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত ওই চোরাই সিন্ডিকেট পিকআপ ভর্তি করে এসব কাঠ পাচার করছে। এর মধ্যে রয়েছে মূল্যবান চন্দন কাঠ, সেগুন কাঠ, সামাজিক বনায়নের কাঠ, বন বিভাগের অবশিষ্ট মূল্যবান কাঠ, রাবারসহ বিভিন্ন চোরাই পণ্য। কয়েকটি অংশে বিভক্ত হয়ে কাঠ চোরাকারবারিরা এসব কাজ করে থাকে। এর মধ্যে একটি অংশ দেশের বিভিন্ন দুর্গম বনভূমি ঘুরে গাছ শনাক্ত করে। আরেকটি অংশ রাতারাতি ওইসব গাছ কেটে তক্তা বানিয়ে তেলবাহী লরি, কখনো ট্রাকের ইটের সারির নিচে চাপা দিয়ে দীর্ঘ পথ বহন করে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) তথ্যমতে, গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পাচারের সময় জব্দ করা হয়েছে ২২ হাজার ৬১৯ ঘনফুট কাঠ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাঠ জব্দ করা হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বরে, ৫ হাজার ১৯৮ ঘনফুট। এ কাঠের মধ্যে রয়েছে রক্তচন্দন, শ্বেতচন্দন, সেগুন, শালসহ আরো কয়েকটি মূল্যবান প্রজাতি। এ ধরনের কাঠ সবচেয়ে বেশি পাচার হয় বেনাপোল ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে।
সরকারী এবং সামাজিক বনায়ন রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে বন বিভাগ। কিন্তু বনবিভাগের লোকেরাই বনখেকোদের কাছ থেকে মোটা অর্থ নিয়ে কাঠ পাচারে সাহায্য করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে বন অধিদপ্তর নিজেদের অক্ষমতায় কাঠ পাচার হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।
নিজেদের সংকটের কথা জানিয়ে বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, দুই হাজার একর বনভূমির তত্ত্বাবধানে থাকেন মাত্র চার থেকে পাঁচজন কর্মী। সমতলভূমিতে স্টেশনভিত্তিক ডিউটি কার্যক্রম পরিচালনা করা গেলেও দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় তাদের থাকার জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা নেই। ফলে প্রতিদিন বনরক্ষীদের ডিউটি শেষে ফিরে আসতে হয়। আর এ সুযোগটির জন্যই ওঁৎ পেতে থাকে কাঠ পাচারকারীরা।
আরো জানান, বনভূমি রক্ষায় আমাদের নিয়মিত মনিটরিং ব্যবস্থা রয়েছে। গাছ কাটা হচ্ছে বা বনভূমি ধ্বংসের খবর পাওয়া মাত্রই আমরা তা উদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। তবে আমাদের বেশির ভাগ বনভূমিই দুর্গম এলাকাতে হওয়ায় সেখানে কেউ গাছ কেটে নিলে সেই খবর আমাদের পেতে একটু সময় লেগে যায়। তবে আমরা চেষ্টা করি পরবর্তী সময়ে ওই অপরাধীদের অনুসরণ করে গাছগুলো উদ্ধারের পাশাপাশি নতুন করে বনায়নের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের।
বন অধিদপ্তরের ভাষ্যমতে, বর্তমানে দেশে বনভূমি রয়েছে ১৬ লাখ হেক্টর। বিশাল এ বনভূমি রক্ষায় নেই পর্যাপ্ত লোকবল। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে মূল্যবান গাছ কেটে নিচ্ছে চোরাকারবারিরা। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি চোরাই কাঠের কারবার হয়ে থাকে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায়। বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকাগুলো থেকে প্রতিনিয়তই মহামূল্যবান বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ কেটে পাচার করে আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি চক্রের সদস্যরা।
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, কাঠ পাচারের সাথে বন বিভাগের লোকজন জড়িত রয়েছে। বনবিভাগের লোকেরাই বনখেকোদের কাছ থেকে মোটা অর্থ নিয়ে কাঠ পাচারে সাহায্য করছে। বন বিভাগের লোকেরা গাড়ী প্রতি এক-দেড় হাজার টাকা করে পায় বলেও অভিযোগ করেন তারা।
অনেকের অভিযোগ, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ এবং বন অধিদপ্তরের সমর্থন ব্যতিত এত এত কাঠ পাচার সম্ভব নয়। এসব কাঠ পাচারে নিজেদের স্বার্থ রয়েছে বলেই চোরাকারবারিরা মূল্যবান কাঠ পাচার করে থাকে।
বন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বন অধিদপ্তর লোকবল অভাবের যে অজুহাত দেখিয়েছেন তা মোটেও ধোপে টেকানোর মতো নয়। দেশ থেকে এত এত কোটি টাকার কাঠ পাচার হচ্ছে যেখানে, বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে, সেখানে লোকবলের অভাবের অজুহাত দেখানো বন অধিদপ্তরের অক্ষমতারই বহিঃপ্রকাশ। তারা মনে করেন, কাঠ পাচারে বন অধিদপ্তরের লোকজনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে জেনে লোকবলের অভাবের অজুহাত বন অধিদপ্তরের অপরাধ চাপা দেওয়ার এক রাজনৈতিক কৌশল। কোটি কোটি টাকার পাচারের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, প্রশাসন এবং বন অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্টতাকে দায়ি করেন তারা। একই সাথে বনায়ন রক্ষার্থে, বনভূমি রক্ষার্থে এসব কাঠ চোরাকারবারি এবং এর সাথে জড়িত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার জন্য সরকারের কর্তাব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
এসডাব্লিউ/বিবি/কেএইচ/১৭৪৪
আপনার মতামত জানানঃ