আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই করছে সমাবেশ। তবে দেখা যাচ্ছে ভীন্ন চিত্র। বাংলাদেশের মানুষ এ যেন এক নীরব নির্বাচন ঘটিয়ে দিচ্ছে। এই যেমন আজ জামালপুর শহরের জিলা স্কুল মাঠে আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন চলছে। আজ সোমবার বেলা দুইটার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ সম্মেলন শুরু হয়। কিন্তু সম্মেলনের আধা ঘণ্টা পর বেলা আড়াইটায় দেখা যায়, মাঠের দর্শকসারির বেশির ভাগ চেয়ার তখনো খালি পড়ে আছে।
এর আগে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সম্মেলনস্থলে গিয়ে দেখা যায়, দলীয় প্রতীক নৌকার আদলে বড় আকৃতির মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। আর মঞ্চের পশ্চিম পাশে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার জন্য করা হয়েছে ছোট একটি মঞ্চ।
তবে সম্মেলনের মাঠের সব চেয়ার খালি পড়ে রয়েছে। সম্মেলনের শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা নেতা-কর্মীরা হাঁটাহাঁটি করছেন। দুপুর ১২টার পর খণ্ড খণ্ড কয়টি মিছিল নিয়ে কিছু নেতা-কর্মী মাঠে প্রবেশ করেন। তবু বেলা দেড়টা পর্যন্ত মাঠের বেশির ভাগ চেয়ার খালি ছিল। এরপর বেলা দুইটায় সম্মেলন শুরু হয়। আড়াইটা পর্যন্ত নেতা-কর্মীরা সম্মেলনস্থলে ছিলেন না।
সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবার কথা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দলীয় নেতা-কর্মীরা বলেন, প্রায় সাড়ে সাত বছর পর সম্মেলন হচ্ছে। সম্মেলনে আসা নেতা-কর্মীদের বেশির ভাগই সবুজ, লাল, হলুদসহ বিভিন্ন রঙের টি-শার্ট আর ক্যাপ পরে এসেছেন। মাঠে বসার জন্য ২৫ হাজার চেয়ার রাখা হয়েছে।
সম্মেলনে আসা স্থানীয় কয়েক নেতা জানান, সম্মেলনের আমেজ অনেকটাই কমে গেছে। হয়তো লোকসমাগমও কম হতে পারে। সাধারণ সম্পাদক পদে কে আসছেন, তা নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা চলছে। ফলে, অনেকে হয়তো ‘সেফ সাইডে’ থাকতে সম্মেলনে আসছেন না। তবে পরিস্থিতি যেকোনো সময় বদলে যেতে পারে।
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সৈয়দ আতিকুর রহমান বেলা দেড়টার দিকে বলেন, দুইটার দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলন শুরু হবে। বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন আসছেন। শুরুর আগেই চেয়ার ও মাঠ ভরে যাবে। আর কেন্দ্রীয় নেতারা সার্কিট হাউসে রয়েছেন। তাঁরা এখনো মঞ্চে যাননি। তাঁরা গেলেই মাঠ ভরে যাবে।
সৈয়দ আতিকুর রহমান আরও বলেন, ২০১৫ সালের ২০ মে জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ ত্রিবার্ষিক সম্মেলন হয়। সম্মেলনে মুহাম্মদ বাকী বিল্লাহ সভাপতি এবং ফারুক আহাম্মেদ চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর ১ বছর পর গঠিত হয় ৭৫ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জেলা আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলন উদ্বোধন করবেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী। সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী, সাংস্কৃতিক সম্পাদক বাবু অসীম কুমার, সদস্য মারুফা আক্তার ও সদস্য রেমন্ড আরেং।
তবে এবারই প্রথম নয়। এমন ঘটনা ঘটেছে আগেও। গত সেপ্টেম্বর মাসেও সারিবদ্ধভাবে বসানো হয়েছিল চেয়ার। যেখানে বসার কথা ছিল কর্মী-সমর্থকদের। তবে সম্মেলন শুরু হলেও চার ভাগের এক ভাগ কর্মীও উপস্থিত ছিলেন না। ফলে কর্মী সংকটে তড়িঘড়ি করে স্থগিত করতে হয়েছে সম্মেলন। জামালপুর সদর উপজেলার ঘোড়াধাপ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে এমন ঘটনা ঘটেছে।
মঞ্চ থেকে মাইক দিয়ে জামালপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হাফিজুর রহমান স্বপন বার বার কর্মী-সমর্থকদের প্যান্ডেলের নিচে অর্থাৎ সম্মেলনে আসার জন্য আহ্বান জানালেও কেউ তার কথায় সাড়া দেননি।
একপর্যায়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহাম্মেদ চৌধুরী বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকার কারণেই এই ঘোড়াধাপ ইউনিয়নটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদকের ব্যর্থতার কারণেই এই পরিণতি।
বিএনপির সমাবেশে জনমানুষের ভীড়
এদিকে বিএনপির সমাবেশে ভীড় বাড়ছে মানুষের। আওয়ামী লীগের দুর্গ বলে পরিচিত ফরিদপুরে শেষ পর্যন্ত বিএনপি সমাবেশ করেছে এবং সেখানে পরিবহন ধর্মঘট উপেক্ষা করে দলের শত শত নেতা-কর্মী যোগ দিয়েছিল। অনেকে ছয় কিলোমিটার হেঁটে সমাবেশ স্থলে যোগ দেন। ফরিদপুর শহরের মোড়ে মোড়ে পুলিশের সতর্ক অবস্থান দেখা গিয়েছে।
উল্লেখ্য, বিএনপির এর আগের গণ-সমাবেশগুলোর মতো এবার ফরিদপুরেও আগের দিন থেকে গণ-পরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে ফরিদপুর শহর কার্যত কার্যত সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শহরে ইন্টারনেট সংযোগও কাজ করছিল না।
ফরিদপুর থেকে স্থানীয় সাংবাদিকরা জানায়, শহরে কোনরকম ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া যায়নি। মোবাইল বা ব্রডব্যান্ড, কোথাও ইন্টারনেট সেবা নেই। তবুও শুক্রবার বিকালের মধ্যেই কোমরপুরের ওই সমাবেশ স্থলে অসংখ্য নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়েছিলেন। তারা সেখানে খণ্ড খণ্ড মিছিল করেছেন। সব মিলিয়ে সেখানে একটি উৎসবের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
সূত্র মতে, বাস ধর্মঘট থাকায় দু’দিন আগ থেকেই নেতাকর্মীরা ফরিদপুর শহরে ভিড় করেন। তাদের অধিকাংশ সমাবেশের মাঠেই রাত-যাপন করেন। সেখানেই চলে খাওয়া-দাওয়া।
এদিকে, বিএনপি’র সমাবেশের একদিন আগেই পুরো বিচ্ছিন্ন বিভাগীয় শহর বরিশাল। অবরুদ্ধ নগরীর প্রবেশ পথে পুলিশের সতর্ক টহল-চেকপোস্ট। পাশের জেলাগুলোতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সতর্ক চোখ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরপাকড়। এমন অবস্থায়ও থামিয়ে রাখা যায়নি জনস্রোত। শুধু নেতাকর্মীরা নয়, এসেছে সাধারণ মানুষও।
আনমনা হয়ে সমাবেশের মাঠে শুয়ে ছিলেন খলিল সরদার। সকাল ছয়টার দিকে মাঠে ঘুমানো মানুষের ছবি তুলতে গিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে পড়েন তিনি। পরনে লুঙ্গি, গায়ে গরম কাপড়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নাম-পরিচয় জানার পর জানা গেল ট্রলারে করে বরিশালে পৌঁছান তিনি। শীতের রাতে অনেকের সঙ্গে অবস্থান নেন মাঠে। অনেক কথার পর তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, এত কষ্ট করে কেন এলেন?
জবাবে খলিল সরদার বলেন, ‘এখন চাউলের কেজি ৬০ টাকা, ৭০ টাকা। চিনির কেজি কিনতে হয় ১২০ টাকা দিয়া। ডাল কিনতে হয় ১২০ টাকা দিয়া, তৈল কিনতে হয় ২০০ টাকা দিয়া। কাজ কইরা ভাত খাইতে পারতেছি না। তয় আমি কীভাবে চলব, কীভাবে খাব। এই জন্য আমি বিএনপির সাথে যোগ দিছি।’
জানা যায়, মো. খলিল সরদার (৬০) এসেছেন বাকেরগঞ্জ উপজেলার বড় রঘুনাথপুর থেকে। তাঁরা একসঙ্গে ১০০ জন এসেছেন। খলিল পেশায় একজন কৃষক। তাদের এক ছেলে ও দুই মেয়ে আছে। জানা যায়, মো. খলিল সরদার (৬০) এসেছেন বাকেরগঞ্জ উপজেলার বড় রঘুনাথপুর থেকে। তারা একসঙ্গে ১০০ জন এসেছেন।
সমাবেশে একজন কৃষকের যোগদানে কি কোনো পরিবর্তন হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে কৃষক খলিল বলেন, ‘পরিবর্তন হইতেও পারে। আমার না হোক আমার ছেলেমেয়ের হবে। আমার মেয়েকে খুবই কষ্ট কইরা আমি পড়াইতাছি। এ বছর মাস্টার্সে ভর্তি হবে। ছেলেটাকে এ বছর বিএ পাস করাইছি। একটা মেয়ে নাইনে পড়ে। বাজারসাজার নিয়া হে গো চালাইতে আমার খুবই কষ্ট হইতেছে।’
খলিল সরদার জানান, সবকিছুর দাম বাড়তি। কাজেকর্মে, ব্যবসা-বাণিজ্যে কোথাও শান্তি নেই। সবদিকে মানুষ কষ্ট করছে। এলাকার পরিস্থিতি জানতে চাইলে খলিল সরদারের জবাব, ‘এলাকার পরিস্থিতি এ রকমই। আগে যারা ছিল ওইটা (আওয়ামী লীগ) এখন মনে করেন তারাও চলে আসছে যে আমাদের সামনে তো আরও দুর্ভাগ্য হইতে পারে, শেখ হাসিনা সাব (সাহেব) নিজের মুখেই বলছেন, সামনে আরও দুর্ভাগ্য (দুর্ভিক্ষ) হইত পারে। তই এখন আমরা সাধারণ পাবলিক দেখতাছি তো ঠিকই, আজকে দর হয় একটা, কালকে দর একটা। ঘণ্টায় ঘণ্টায় মালের দাম বাড়তি হয়।’
সরকার পরিবর্তন হলে কি দুর্ভিক্ষ কমবে? জবাবে খলিল বললেন, ‘দুর্ভাগ্য (দুর্ভিক্ষ) হয়তো কমে যাইতেও পারে। মনে করেন, এখানে দশের লগে থাইকা আগাই দেওয়ার জন্য আসছি আর কী।’
এদিকে পটুয়াখালীর লাউকাঠি থেকে সমাবেশে এসেছেন মরিয়ম বেগম। সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে তাকে উদ্যানের পূর্ব পাশে বসে খিচুড়ি খেতে দেখা যায়। পরিচয়ে জানা গেল, তিনি লাউকাঠি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি। গত ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছিলেন। গত রাতে মাঠেই ছিলেন।
কীভাবে এলেন জানতে চাইলে মরিয়ম বলেন, ‘আইছি বড় কষ্ট কইররা। ভাইঙ্গা ভাইঙ্গা, হাইট্টা আইছি, রিশকায় আইছি, অটোতে আইছি।’ কষ্ট কি সফল হবে? মরিয়মের জবাব, ‘অ্যা কইথারে আল্লায়। চেষ্টা তো করতে অয়।’
প্রায় ৮০ বছর বয়সী আবদুল মান্নান ফকির বানারীপাড়া থেকে এসেছেন। রাজমিস্ত্রির কাজ করেন তিনি। চার কন্যাসন্তানের জনক মান্নান ফকির নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেও পরিচয় দেন। গতকাল বিকেলে তিনি মাঠে পৌঁছান। যাত্রাপথে বানারীপাড়া থেকে গড়িয়ারপাড় পর্যন্ত হেঁটে আসেন। বাকি পথ ভ্যানে করে বরিশালে পৌঁছান। রাতে মাঠেই ঘুমান। খাওয়াদাওয়াও করেন মাঠে।
কষ্ট করে সমাবেশে আসার কারণ জানতে চাইলে আবদুল মান্নান ফকির বলেন, ‘খালেদা জিয়ার জন্যই এত কষ্ট করতাছি। যে দেশটা কোথায় চইল্লা যাইতাছে। মাল-জিনিসের দাম এত বাড়াইয়া হালাইছে, আমরা ভাত খাইত পারি না।’
সকাল পৌনে সাতটার দিকে মাঠের মাঝ বরাবর একটি প্যান্ডেলে গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে কথা হয় জি এম শহিদুল ইসলামের। পরিচয়ে জানালেন, তিনি পটুয়াখালী জেলার দশমিনা থেকে এসেছেন। শহিদুল ইসলাম পেশায় আইনজীবীর সহকারী। তিনিও ট্রলারে করে দিবাগত রাত দুইটায় বরিশাল পৌঁছান। তাঁরা ৭৪ জন একসঙ্গে ট্রলারে এসেছেন।
শহিদুল জানান, তিনি ৬ নম্বর বাজবাড়িয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক। দলকে ভালোবাসেন, দলের স্বার্থে এসেছেন। মাঠেই রাত কাটিয়েছেন। কাঁধের ব্যাগটি দেখিয়ে এ-ও জানালেন, ভেতরে কাফনের কাপড়ও নিয়ে এসেছেন।
কাফনের কাপড় সঙ্গে রাখার কারণ জানতে চাইলে শহিদুল ইসলামের জবাব, ‘যদি মৃত্যু হয় এই কাফন দিয়েই দাফন করবে। আমরা সেই প্রস্তুতি নিয়া আসছি। আমরা বেগম খালেদা জিয়ার জন্য শাহাদতবরণ করতে কোনো ভয় পাই না।’
এলাকায় ক্ষমতাসীনদের হাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন? উত্তরে শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত হইছি না!, তিনটা মামলা আছে আমার মাথার ওপর।’
গোটা দেশেই যেন বিপ্লবের একটা আলো ছড়িয়ে পড়ছে। সব বাধা পেরিয়ে সমাবেশে আসছে মানুষ। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বেশিরভাগ মানুষই পায়ে হেঁটে, মাছ ধরার ট্রলার, বালু টানার কার্গো ও বাইসাইকেল নিয়ে বরিশালে পৌঁছান। পরে তারা একত্র হয়ে মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসেন।
এসডব্লিউএসএস/১৮৪৩
আপনার মতামত জানানঃ