রাজনীতির মাঠ থেকে প্রতিপক্ষকে পুরোপুরি অদৃশ্য করতে গেলে যে নিজেদেরই অদৃশ্য হয়ে যেতে হয়, তার প্রমাণ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ। আওয়ামী লীগ চেয়েছিল, তাদের বলয়ের বাইরে কেউ থাকবে না। প্রশাসন চলবে আওয়ামী লীগের কথায়। পুলিশ চলবে আওয়ামী লীগের কথায়। মিডিয়াও কথা বলবে আওয়ামী লীগের ভাষায়।
এখন সেই আওয়ামী লীগ কোথাও নেই। গত ৫ আগস্ট ছাত্র গণ–অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দল হিসেবেও আওয়ামী লীগ ‘অদৃশ্য’ হয়ে গেছে। এর আগে আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি প্রধান বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করেছে, এমনকি সংসদে না থেকেও। আবার বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগই ছিল প্রধান বিরোধী দল।
এবার মাঠে আওয়ামী লীগ নেই। ফলে বিএনপির সামনে আপাতত কোনো চ্যালেঞ্জ থাকার কথা নয়। তারপরও বিএনপির নেতাদের কণ্ঠে বিরাজনৈতিকীকরণ ও মাইনাস–টু থিয়োরির কথা শোনা যায়। তাঁদের দাবি, আওয়ামী লীগ হটিয়ে কোনো কোনো পক্ষ বিএনপির ক্ষমতায় আসার পথও রুদ্ধ করতে চায়। এই পক্ষগুলো কারা, বিএনপির নেতারা তা খোলাসা করে বলছেন না। হাওয়ায় নানা কথা ভেসে আসছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম লক্ষ্য ছিল সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত কমিশনগুলোর রূপরেখা তৈরি করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসবে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো আপত্তি জানিয়েছে। তারা বলেছে, রূপরেখা চূড়ান্ত করে বসার অর্থ হচ্ছে তাদের দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নেওয়া। সেটা হতে পারে না। এরপর সরকার ঠিক করেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর কথা শোনার পরই কমিশনগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করবে।
শনিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রথমে সংলাপে বসেন বিএনপির নেতাদের সঙ্গে। বিএনপির প্রতিনিধিদলে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও সালাহউদ্দিন আহমেদ।
এরপর আলোচনা করেন যথাক্রমে জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ, হেফাজতে ইসলাম, বাম গণতান্ত্রিক জোট, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি ও গণ অধিকার পরিষদের নেতারা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তার জোটসঙ্গীদের এই সংলাপের বাইরে রাখা হয়েছে।
সংলাপে আগামী জাতীয় নির্বাচন, নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কারসহ মোটামুটি ১৮টি বিষয়ে কথা বলেছে বিএনপি। তবে দলটির মূল চাওয়া ছিল কবে নাগাদ নির্বাচন হবে, তার একটি রোডম্যাপ। একই সঙ্গে বিএনপি নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার করে অনতিবিলম্বে নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে।
বিএনপির প্রতিনিধিদল এক ঘণ্টার বেশি সময় বৈঠক করে। বিকেল চারটায় বৈঠক থেকে বের হয়ে প্রতিনিধিদলের প্রধান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। আলোচনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আলোচনার প্রধান বিষয় হচ্ছে নির্বাচন-সম্পর্কিত। কবে নির্বাচন হবে, সে বিষয়ে একটি রোডম্যাপ দিতে বলেছি।’
প্রেস ব্রিফিংয়ে মির্জা ফখরুল নির্বাচনের ‘রোডম্যাপ ও সময়সীমা’ সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমি মাস, দিন, কাল নিয়ে কথা বলব না। উনি (প্রধান উপদেষ্টা) আমাদের বলেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠান তাঁদের ১ নম্বর প্রায়োরিটি (অগ্রাধিকার)। বিষয়গুলো অত্যন্ত সহযোগিতার সঙ্গে তাঁরা দেখছেন। তাঁরা মনে করেন, আমাদের দাবিগুলো হচ্ছে জনগণের দাবি, আমাদের দাবিগুলো তাঁদেরও দাবি।’
এ ক্ষেত্রে নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির কোনো দ্বিমত আছে বলে মনে হয় না। তারপরও যখন বিএনপির নেতাদের মুখে নির্বাচন নিয়ে সংশয় এবং মাইনাস টু থিওরির কথা শোনা যায়, তখন প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি দৃশ্যের বাইরেও কিছু ঘটছে?
একই দিন শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোট আয়োজিত সমাবেশে মির্জা ফখরুল বলেন, তাঁরা কোনো বিরাজনৈতিকীকরণের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না। আবার ‘মাইনাস টু’ দেখতে চান না। তিনি বলেছেন, ‘আমরা আবার এই মৌলবাদ বা জঙ্গিবাদকে দেখতে চাই না। আমরা আবার সন্ত্রাসকে দেখতে চাই না। আমরা সত্যিকার অর্থে দেশে একটা সুস্থ, উদারপন্থী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেখতে চাই।’
মির্জা ফখরুলের এই বক্তব্যে শঙ্কা ও আশা দুটোই আছে। শঙ্কা হলো ‘মাইনাস টু’। আর আশা হলো উদারপন্থী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। একই সঙ্গে তিনি মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ দেখতে চাই না বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। বিএনপির নেতারা জানেন, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ তাদের আগের শাসনামলকে কী অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিল। মহাসচিবের এই অভয়বাণী যেমন দেশবাসীর জন্য, তেমনি বিদেশি বন্ধুদের জন্যও।
মির্জা ফখরুল শুধু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলেননি। বলেছেন উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। বিএনপির একদা মিত্র ইসলামী দলগুলো এ রকম উদার গণতন্ত্র পছন্দ করবে না।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে যখন আওয়ামী লীগ নেতারা মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বুলন্দ আওয়াজ তুলতেন, তখন বিএনপির নেতারা একে রাজনৈতিক অপপ্রচার বলে অভিহিত করতেন। এখন তাঁরা মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন।
এর মাধ্যমে হয়তো তারা এই বার্তাই দিতে চান যে এখনকার বিএনপি আর আগের বিএনপি এক নয়। সাম্প্রতিককালে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের কণ্ঠেও ভিন্ন সুর শোনা যাচ্ছে। ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে জোট করার চেষ্টা করছে তারা।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে মাইনাস টু একটি অতি জটিল প্রশ্ন। এক–এগারোর পর যাঁরা ক্ষমতায় এসেছিলেন, তাঁরা সত্যিকার অর্থেই মাইনাস টু চেয়েছিলেন। এমনকি তাঁদের এই চাওয়ায় দুই দলের অনেককে কাছে টেনেছিলেন। পরে যখন তাঁরা অবস্থা বেগতিক দেখলেন, তখন নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা দেওয়াই শ্রেয় মনে করলেন। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বইয়েও সাবেক সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের বর্ণনা আছে।
সেই সরকার কোনো আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেনি। কিন্তু এবারে অন্তর্বতী সরকার এসেছে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের ফসল হিসেবে। রাষ্ট্র সংস্কারের অঙ্গীকার নিয়ে তারা এসেছে। তারা শুরু থেকে বলেছে, তাদের রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। তারপরও বিএনপির নেতাদের মুখে মাইনাস টুর শঙ্কা দেশবাসীকে না ভাবিয়ে পারে না। সূত্র: প্রথম আলো।
আপনার মতামত জানানঃ